দেশে উৎপাদিত গ্যাস, সৌর প্লান্টসহ নিজস্ব সম্পদে নির্ভরতা বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানান কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দেশে উৎপাদিত গ্যাস, সৌর প্লান্টের ব্যবহার ও কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানোসহ নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদ ও পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "যুদ্ধের কারণে তেলের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা আমরা জানি না। ৩ থেকে ৪ বছর আমাদের সতর্কভাবে চলতে হবে। আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে।"
শনিবার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের সভাপতি মোজাম্মেল বাবুর সভাপতিত্বে 'বিশ্ব জ্বালানি সংকট ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন সরকারের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
"আমাদের ত্যাগ শিকার করতে হবে। লোড শেডিং এ সরকারের লাভ হচ্ছে, কিন্তু জনগণের ক্ষতি হচ্ছে। এ যুদ্ধ চলুক কিংবা না চলুক গ্যাসের দাম এক সময় কমে আসবে। ২০৩০ সালের পরে বিশ্বে ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যতীত অন্য কোনো গাড়ি চলবে না। আগামী ৫ থেকে ১০ বছর পরে তেলের দাম কমে আসবে। গ্যাসের দামও আস্তে আস্তে কমে আসবে। আমাদের মজুদকে কমিয়ে আনতে হবে", বলেন ড. আহসান এইচ মনসুর।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরে পেট্রোল-অকটেনে লাভ হলেও ডিজেলে লোকসান হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এম বি এম আজাদ বলেন, "১৯৯৯ থেকে ২০১৩/২০১৪ সাল পর্যন্ত বিপিসিকে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। সেটি সাপ্লাই চেইন রক্ষা করেই পোষাতে হয়েছে। তার থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার মতো সরকারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখনও ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়ে গেছে।"
বিপিসি প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে, সরকার বিভিন্ন সময় হাজার হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে এসব নিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, বিপিসির জন্ম হয়েছে ১৯৭৭ সালে। তখন এর কাজ শুরু হয়। তখন মাত্র ১২ থেকে ১৩ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের ব্যবস্থাপনা করা হতো। ২০০৫/২০০৬ পর্যন্ত প্রায় একই রকম ছিল। এরপর থেকেই বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ৬৮ থেকে ৭০ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল সারা বছর বিপিসি হ্যান্ডেল করে। সরকার কখনও লোন দিয়ে, বন্ড দিয়ে আমদানির কাজটিকে সচল রেখেছে। বিভিন্নভাবে সরকার প্রায় ৪৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা সাপোর্ট দিয়েছিল। ২০১৫ সালের দিকে যখন বিপিসি সক্ষমতা অর্জন করলো, তখন প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লাভ থেকে সেগুলো কাভার করা হয়।
২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত লাভ হয়েছে ৪২ হাজার ৯ শত ৯২ কোটি টাকা।
এই টাকার হিসাব বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "এখান থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা সরকারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। ৩৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। যেটি সম্পূর্ণ বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে। এর মধ্যে ১২ টি প্রকল্প চলমান আছে। যার ৫ টি প্রকল্প প্রতিটি ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার। এ টাকা কোথাও ব্যয় করা হয়নি, বিভিন্ন কাজে ইনভেস্ট করা হয়েছে।"
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "২০১৯ সালে কোভিডের সময় এতো পরিমান দাম কমেছে যে, আমাদের তো ক্যাপাসিটি আছে, তবে তখন মজুদ করে রাখার মতো ক্যাপাবিলিটি ছিল না।"
এনবিআর ট্যাক্স মওকুফ করুক এটা চান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ট্যাক্স মওকুফ করুক এটা চাই না। কারণ পুরো ট্যাক্স স্ট্রাকচারটি সরকারের একটি নীতিমালার মধ্যে রয়েছে। এখানে সিস্টেমকে অনুসরন করা আমার দায়িত্ব। সরকার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটিই করবে বিপিসি।"
বিপিসির দায়িত্বে তিনি দক্ষ কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "আমি সর্বোচ্চ দক্ষ না হলেও অন্তত গত ৩৬ বছরে বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহ রাখার জন্য যে দক্ষতা দরকার সেটা এখন পর্যন্ত আছে।"
বিপিসিতে দুর্নীতি সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। বিপিসি এমন একটি কাঠামোতে চলে যেখানে ইমপোর্ট, মজুদ একটি নিয়মে হয়। ব্যবস্থাপনায় বলা হয়ে থাকে, আন্তর্জাতিকভাবে পিলফিরেজ মানদণ্ড ০.৩% সেখানে, আমাদের হয় ০.২%; যা অনেক কম।"
১৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন দার্জিলিং টু পার্বতিপুর ডিজেলের। সেখান থেকে ডিজেল আমদানি করা যায় কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, "সেটা এখনও শুরু হয়নি। কাজ শেষ পর্যায়ে। এটি মূলত উত্তরবঙ্গের ডিজেলের চাহিদা পূরণ করবে।"
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, "তেলের বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে দামে। তেলের টাকা অন্য খাতে যাবে কেন? এখন যে লোডশেডিং হচ্ছে, তাও সিস্টেমিক সমস্যা। দেশের পুরো পাওয়ার সিস্টেম ভুল পথে রয়েছে। বিপিসি যে প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করছে তা সঠিক নয়।"
এডিটরস গিল্ডের সদস্য এবং 'পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি'র সম্পাদক মোল্লা এম আমজাদ হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই, এটি সবাই স্বীকার করছে। কিন্তু আমাদের কি এলএনজি আমদানির সক্ষমতা আছে? আমাদের নিজস্ব সম্পদ উত্তোলন করতে হবে। এগুলো উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। গ্যাস-কয়লার অনুসন্ধানে মনযোগ দিতে হবে।"
পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বলেন, সরকার কিছুই নয়, সরকার হচ্ছে জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের যে আয়, জনগণের উপর যে কর অর্থাৎ জনগণের অর্থেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। সুতরাং এটি সরকার পরিচালনা করে কোন খাতে কতো আয় করবে, কতো ব্যয় করবে, কোন খাতকে সাবসিডি দেবে, তা নির্ধারণ করবে।
তিনি বলেন, "দাম এভাবে হঠাৎ করেই বাড়ানো হয়। যদি আগে থেকে বাড়ানো হয়, তাহলে কোনো পেট্রোল পাম্পে কিন্তু তেল পাওয়া যেত না। সরকার ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারে এবং সরকার সেটাই করেছে জনগণের কল্যাণে। একটি দেশের অগ্রগতি নির্ভর করে তার কতোটুকু জ্বালানি আছে তার উপর। এখনকার জ্বালানির চাহিদা আর ১৯৯৬ সালের জ্বালানির চাহিদা এক হতে পারে না।"
তিনি বলেন, "২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমরা ৫ টি এক্সপ্লোরেশন কূপ করেছি। এরমধ্যে ৩ টিতে আমরা গ্যাস পেয়েছি।"
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, "এক্সপ্লোরেশন এমন একটি জিনিস এটি চট করে হয় না। এর দীর্ঘসূত্রিতা থাকে। আমাদের দেশ খুবই গ্যাসপ্রবণ, এটি জিওলজিক্যালি প্রমাণিত। দেশে বিদেশে সকলেই এটা জানেন। এ গ্যাস এক্সপ্লোরেশনে কতোটুকু উন্নতি হয়েছে সেটা জানতে হবে অনেক পেছন থেকে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের এ অঞ্চলে ১৯১০ সালে প্রথম গ্যাসের কূপ খনন হয়। মূলত এক্সপ্লোরেশন শুরু হয়েছে ১৯৫০ সালের পরে। বর্তমানে অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা ৯৮ টি। আবিস্কার হয়েছে ২৮ টি গ্যাস ক্ষেত্র। বিশ্বে এ হার ২০% কিন্তু আমাদের হার প্রায় ৩০%। আমাদের জায়গাটি সম্ভাবনাময় এটা সত্য।"
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, "বাংলাদেশের যে অবস্থা, তাতে হতাশ হওয়ার কথা না। আমাদের ল্যাকিংস না থাকলে আমরা অনেক এগিয়ে যেতাম। কয়লা অবশ্যই লাগবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণে যেগুলো আছে সেগুলো ঠিক রাখতে হবে।"
এখনও দেশের অনেক জায়গায় আছে ২২ ঘন্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, "লোড ব্যবস্থাপনা আমাদের ঠিকমতো রাখতে হবে। পুরো দেশের মধ্যে লোড ডিস্ট্রিবিশন ঠিক নেই। গ্রামে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২২ ঘন্টা লোডশেডিং দিলে, আবার শহরে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোনো লোডশেডিং না রাখলে সেটি বৈষম্য হবে।"
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় তেল-গ্যাসের দাম বারবার বাড়ানো-কমানো সম্ভব নয়। বহির্বিশ্বের চেয়ে দেশে দাম কম, সেজন্য এটি করা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে ব্যাপকভাবে সৌর বিদ্যুৎ এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শও দেন তিনি।
অপচয় কমিয়ে কৃষিতে সৌরবিদ্যুতের উপর নির্ভশীলতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার আব্দুস সালেকও।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, "বিএনপি গ্যাস রপ্তানি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে নেতিবাচক বার্তা গেছে। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে, ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র জয় করেছে।"
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, "শক্তির চাহিদাকে সমন্বয় করতে হবে। দেশের অনেক জায়গায় বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ থাকে না। লোড ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখতে হবে। তবে সামনে শীত আসছে, ভয়ের কারণ নেই।"