ওয়াশিংটন নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করতে চায়...এটা একটা বিপজ্জনক চিন্তা
চলতি মাসে তাইওয়ান সফরে গিয়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেন মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। বেইজিং তীব্র বিরোধিতা করলেও–তাতে গা করেননি তিনি। ক্ষুদ্ধ চীন তার সফরের সময় থেকে পাঁচদিন ব্যাপী সামরিক মহড়া চালিয়েছে।
চীনের মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল 'শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে (তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সাথে ) পুনঃএকত্রীকরণ' -এর সামরিক শক্তিকে প্রদর্শন করা। রাশিয়ার সাথে ন্যাটো জোটের ছায়াযুদ্ধ যখন ইউক্রেনে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করছে- তার মধ্যেই পেলোসি গিয়েছিলেন বেইজিংকে উস্কে দিতে।
পেলোসির দীর্ঘদিনের চীন-বিরোধী মনোভাব আমলে নিয়েও বলা যায়, এই সফর আকস্মিক ছিল না। আসলে ওয়াশিংটনে চীন ও রাশিয়ার সাথে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর আগ্রহ দিনকে দিন আরও দৃঢ় ভিত্তি পাচ্ছে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় দলে । মার্কিন স্পিকারের এ সফর ছিল তারই অংশ।
ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জশ রজিন লিখেছেন, 'এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশেই আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করাকে নিজ দায়িত্ব বলে মনে করছেন উভয় দলের নেতারা'।
এরপর তিনি লিখেছেন, আমেরিকা প্রমাণ করেছে– চাইলে সে চীন ও রাশিয়াকে একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এরমধ্যেই ন্যাটো জোটে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের যোগ দেওয়াকে ৯৫-১ ভোটের ব্যবধানে অনুমোদন দিয়েছে মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট। পেন্টাগন যতটা চেয়েছিল–তার চেয়েও বেশি অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন রাজনীতিবিদেরা।
কাউন্টার পাঞ্চ- গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্লেষণে ক্যাটরিনা ভ্যানডেন হিউভেল লিখেছেন, আসলে স্নায়ুযুদ্ধই হলো– আমেরিকার জন্য সুবিধাজনক। বিগত স্নায়ুযুদ্ধে আমরা জিতেছি। আমাদের আছে শ্বেতশুভ্র লেবাস। কতৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই বলেছি আমরা গত স্নায়ুযুদ্ধকে। এখনও তাই বলা হচ্ছে। তা ছাড়া, আমাদের সেনাবাহিনী পৃথিবী সেরা। কেইবা তা অস্বীকার করবে?
তিনি বলেছেন, তবু উদ্বেগজনক কিছু প্রশ্ন না রাখলেই নয়। সত্যিই কি রাশিয়া ও চীনকে একসাথে মোকাবিলার নতুন স্নায়ুযুদ্ধ– আমেরিকার প্রকৃত জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের যে প্রতিশ্রুতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন দিয়েছেন– এটি কি তার সাথে সাংঘর্ষিক হবে না? নিজের ঘর সামলানো বাদ দিয়ে বৈদেশিক নীতির জন্য শক্তি ও সম্পদের ব্যবহার কি বেশিরভাগ আমেরিকান মেনে নেবে?
আমেরিকানসহ পুরো বিশ্ববাসীর অস্তিত্ব বিপন্ন করার মতো হুমকি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেখা দেওয়া প্রতিকূল আবহাওয়া। বিশ্বজুড়ে দাবানল, বন্যা, খরা ও রোগ-ব্যাধির সূচনা করে এটি হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি করছে। বাদ পড়ছে না আমেরিকাও। সাম্প্রতিক সময়ের মাঙ্কিপক্স রোগের প্রাদুর্ভাব আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, বৈশ্বিক মহামারির হুমকি আগামীদিনেও থাকবে।
হিউভেল মনে করেন, এই বাস্তবতায় পেন্টাগনের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় কোনো সুফল বয়ে আনবে না। তাইওয়ানে নিয়ে পেলোসির নাটকীয় পারফরম্যান্সের চেয়ে তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট- এর জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন এফ. কেরির সফরগুলো নিয়েই বেশি আলোচনা হলে–আমেরিকা ও বিশ্বের মঙ্গল হতো।
চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন আর মহামারির বিস্তার ঠেকানো যাবে না। পেলোসির সফরে ক্রুদ্ধ চীন এসব বিষয়ে আলোচনা বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে মিত্র সন্ধান করছে। তাদের ঘেরাও করার ঘাঁটি মজবুত করছে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ তুলে ধরেছে সামরিক খাতে রাশিয়ার দুর্বলতা। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাহত হয়েছে রাশিয়া থেকে বিশ্ববাজারে খাদ্য, সার ও খনিজ রপ্তানি। এতে পণ্যগুলির দাম এত বেড়েছে, যা বিশ্বমন্দার সূচনা করতে পারে।
চীনকে 'প্রায় সমকক্ষ প্রতিযোগী' বলে পেন্টাগন। কিন্তু, চীনের শক্তির উৎস তার অর্থনীতি, সামরিক পেশিশক্তি নয়। এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা– বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য অংশীদার চীন।
আমেরিকার অনেক মিত্র চীনের বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। পূর্ব এশিয়ার গণতান্ত্রিক মিত্ররাও রয়েছে সে তালিকায়। হয়তো একারণেই পেলোসি যখন তাইওয়ান যাওয়ার আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাত্রাবিরতি দেন, তখন তাকে স্বাগত জানাতে যাননি দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়োন সুক-ইয়োল।
কিন্তু, মার্কিন গণমাধ্যম দেশটির জনগণকে জানিয়েছে ইয়োল কোনো বিনোদন আয়োজনে ছিলেন সে সময়। পেলোসির সফর যে সিউলের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল সেকথা তারা তুলে ধরেনি- এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন হিউভেল।
তার মতে, দ. কোরিয়া কেবল চীনের নিকট প্রতিবেশী নয়; একইসঙ্গে, আমেরিকার অত্যন্ত অনুগত মিত্র। দেশটিতে মোতায়েন রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মার্কিন সেনা। সিউলের এমন উপেক্ষা প্রমাণ করছে, তারা বেইজিংয়ের সাথে বাণিজ্যের সম্পর্ককে কতোটা গুরুত্ব দেয়।
উত্তেজনার পারদ না চড়িয়ে আমেরিকার উচিত কিছুক্ষেত্রে চীনকে অনুসরণ করা। চীন যেভাবে ভবিষ্যতের বাজারে আধিপত্য করবে এমন নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে জোর দিচ্ছে–সেদিকে আমেরিকার বৈজ্ঞানিক শক্তিকে আরও বেশি নিয়োজিত করা। তা না করে, নতুন প্রজন্মের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার গড়তে এক লাখ কোটি ডলার খরচ করে লাভের লাভ কিছুই হবে না।
স্নায়ুযুদ্ধের পক্ষের বক্তারা জোর দিয়ে দাবি করেন, চীন ও রাশিয়ার চারপাশে মার্কিন সামরিক শক্তি মোতায়েন নাকি নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক!
কিন্তু, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধে স্টিফেন ওয়াল্ট উল্লেখ করেন, এই দাবি 'নিরাপত্তার উভয় সংকট'-কে প্রতিফলিত করে। এক দেশ যা নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে; আরেক দেশের কাছে তাই হুমকির। যুদ্ধের আগেই রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া উচিত এমন কথা বলে এসেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। আর তাতে স্নায়ু বিগড়ে যায় ক্রেমলিনের হর্তাকর্তাদের। তারা প্রমাদ গোনেন, ইউক্রেনে ন্যাটো সেনা আর মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন হতে হয়তো আর বেশি দেরি নেই।
তার ওপর আবার বাইডেন বলেছেন, পুতিনের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। তাকে প্রতিধ্বনিত করেছেন আমেরিকার অন্য রাজনীতিকরা। বিশ্বজুড়ে আমেরিকার ইচ্ছেমতো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের যে ইতিহাস আছে– তাতে সব মিলিয়ে রাশিয়ার মরিয়া হয়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক।
আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে চীনের প্রদেশ হিসেবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ তারপরও দ্বীপটিকে অস্ত্রসজ্জিত করছে। প্রশান্ত মহাসাগরে আরও বেশি সামরিক শক্তি মোতায়েন করছে। পেলোসি তার সফরকে বলেছেন, 'আমাদের গণতান্ত্রিক অংশীদার, তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতীক' ছিল এটি।
বেইজিং একে মনে করেছে চীনের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। আমেরিকার আনুষ্ঠানিক 'এক চীন' নীতি থেকে সরে আসা এবং তাইওয়ানে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে জনমতকে উৎসাহিত করার অপচেষ্টা।
স্নায়ুযুদ্ধের পক্ষপাতীরা মনে করে, বিশ্বের অধিকাংশ অংশ আমেরিকার সাথে আছে। ন্যাটো জোটের ক্ষেত্রে হয়তো তা সত্য। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ আমেরিকার সাথে এখন অনেক বেশি একাত্ম। কিন্তু, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার বসবাস যেসব দেশে– তারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে অস্বীকার করেছে।
আমেরিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক আইন-ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার দাবিতে উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষেরই আস্থা নেই। একারণেই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ততোটা ধারালো ছুরি হয়ে উঠতে পারেনি। চীন বিপুল পরিমাণে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যার পরিমাণ বেড়েছে ৭২ শতাংশ। এই ঘটনায় চীনের 'কোমল শক্তি' যে ক্রমে বাড়ছে তাও প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে, অসার প্রমাণিত হয়েছে আমেরিকার সামরিক চোখ রাঙানির চিরকালীন মুদ্রা।
হিউভেল নিজ দেশের রাজনীতিবিদদের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণেই বিশ্বশক্তিগুলোর পতন হয়।
আমেরিকায় দ্বিদলীয় রাজনীতি যখন বিষাক্ত হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই উভয়পক্ষের নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর উৎসাহ যেন সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য। কিন্তু, পুরোনো অভ্যাসের বশে চলতে চলতে, আগামী দিনের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও অসম্ভব। এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত আমেরিকান গণতন্ত্র নির্মাণের কৌশলও হতে পারে না।
- সূত্র: কাউন্টার পাঞ্চ