নজরুলের গানের হারানো নোটবুক কলকাতায় আট দশক পর প্রদর্শনীতে দেখানো হলো
বাংলা সাহিত্যের অমর কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন কলকাতায়। তাই তিনি দুই বাংলারই সম্পদ। গঙ্গা-পদ্মাকে একই বাহুডোরে বাঁধার মিলনসেতু। তার ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ২৭ আগস্ট। নজরুলের এবারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় প্রদর্শিত হচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া গানের নোটবুক। ২০১৫ সালে আকস্মিকভাবেই যেটি আবিষ্কৃত হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানে।
গানের খাতাটি আজ সোমবার (২৯ আগস্ট) প্রদর্শিত হয়েছে, কলকাতা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উত্তরপাড়ার জীবনস্মৃতি আর্কাইভে। আর্কাইভটি বাঙালি ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের কাজ করে।
এখানকার আর্কাইভবিদ অরিন্দম সাহা সর্দার-ই প্রথমে খুঁজে পান গানের নোটবুকটি। এতে স্বরলিপি লিখে দিয়েছিলেন, নজরুলের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীত সহচর ও স্বরলিপিকার জগৎ ঘটক। নজরুল রচিত ও সুর করা ৩৬টি গানও রয়েছে এতে।
নিজ স্মৃতিচারণায় জগৎ ঘটক লিখে গেছেন, ১৯৪০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নোটবুকটি সাথে নিয়ে কলকাতা বেতার স্টেশনে গান গাইতে যান কাজী নজরুল। গান গাওয়ার সময়েই তিনি বেশ সেটির কথা জিজ্ঞেস করেন। রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর যখন খোঁজ করা হলো, তখন দেখা যায় সেটি কোথায় গেছে– তা কেউই বলতে পারছে না।
ঘটক জানান, 'ওই দিন বেতার অফিসে কে কে ছিল– তা সবিস্তারে মনে রেখেছিলেন নজরুল। নোটবুক খুঁজতে তিনি তাদের সবার বাড়ি যান। কিন্তু, তাতে লাভ হয়নি। কীভাবে সেটি হারালো- তাও মনে করতে পারছিলেন না। এই শোকে তিনি বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আরও অনেকের কাছেই নোটবুকটির কথা জানতে চেয়েছেন এবং পত্রিকাতেও এর সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন। যদিও, সব চেষ্টাই বিফলে যায়'।
কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় পুরোনো বই খুঁজতে খুঁজতেই প্রায় ৮ দশক পর নোটবুকটি ভাগ্যক্রমে খুঁজে পান অরিন্দম সাহা।
সেই স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, 'বুঝতে পারছিলাম, কী অমূল্য গুপ্তধনের সন্ধান আমি পেয়েছি। তবে এটি আসল কিনা তা যাচাই করতে ঘটকের মেয়ের শরণাপন্ন হই'।
নোটবুকে যেসব নজরুল গীতি স্বরলিপি সহকারে উল্লেখ ছিল তার মধ্যে রয়েছে– 'এসো চিরজনমের সাথী', 'আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশী', 'খেলে নন্দের আঙ্গিনায়', 'আমি পথ-মঞ্জরি', 'এসো চিরজনমেরও সাথী', 'না মিটিতে আশা', 'সন্ধ্যা মালতি যবে' এবং 'বন-কুন্তল এলায়ে'-র মতো বিখ্যাত সব গান।
নোটবইটি হারানো নিয়ে নজরুলের মর্মবেদনার কথা জানাই ছিল অরিন্দম সাহার। তিনি সে ঘটনা উল্লেখ করে জগৎ ঘটকের কন্যা মধুমিতা চ্যাটার্জিকে একটি চিঠি লেখেন।
অরিন্দম বলেন, 'শেষপর্যন্ত এটির সন্ধান মেলায় মধুমিতা বেশ খুশি হয়েছিলেন। সানন্দেই তিনি এটি আমাদের আর্কাইভকে দান করতে রাজি হন, যাতে আমরা এর ডিজিটাল কপি তৈরি করতে পারে। মূল নোটবইটিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করছি। নজরুলের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২৯ আগস্ট এটি প্রদর্শন করা হবে। নজরুলপ্রেমীদের এটি একবার দেখার সুযোগ করে দিতেই এ প্রচেষ্টা'।
নজরুল ভক্তদের জন্য উত্তরপাড়ার এই আর্কাইভে আরও রয়েছে, তাকে নিয়ে লেখা ৩৫০টি দুর্লভ বই এবং নজরুলের লেখা বইগুলির প্রথম সংস্করণ। তিনি যেসব চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, তাদের তথ্যও এখানে সংরক্ষিত রয়েছে।
চলচ্চিত্রগুলির বুকলেটও রয়েছে এখানে। এরমধ্যে একটি বুকলেট 'ধ্রুব' সিনেমার। এটি নজরুলের সহ-পরিচালনায় নির্মিত একমাত্র চলচ্চিত্র।
অরিন্দম সাহা বলেন, 'তিনি এই সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন। ছিলেন এর সুরকার, গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালক। 'চৌরঙ্গী' সিনেমাতেও ছিলেন সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক।
'আগেকার দিনে সিনেমা রিলিজের আগে শিল্পী-কুশীলব-সহ বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বুকলেট ছাপাতো চলচ্চিত্র কোম্পানিগুলো। বর্তমানে এমন ৫০টি বই আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। আমরা নজরুলের লেখা প্রায় ১,৪০০ গান ডিজিটাইজড করছি। ১৯২৫ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে গানগুলি রিলিজ হয়েছিল'- যোগ করেন তিনি।
- সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া