বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে অভিভাবক শিক্ষার্থীদের কঠোর অবস্থান
হাইলাইটস:
• চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়
• এ ঘোষণায় বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়
• ক্যাম্পাসে রাজনীতি চালুর উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবকেরা ১৫,০০০ চিঠি দিয়েছেন
• বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, তারা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালাতে দেবে না
সম্প্রতি দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরপরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষগুলো জানিয়ে দেয়, তারা তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগের প্রতিবাদে চিঠির স্রোত পাঠান শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
অ্যাসোসিয়েশন অভ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অভ বাংলাদেশের (এপিইউবি) তথ্যানুসারে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির অনুমতি না দেওয়ার জন্য গত কয়েকদিনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায় ১৫ হাজার চিঠি পাঠানো হয়েছে।
অনেকে বলেছেন, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেরকম অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে সেটি তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে চান না।
মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু নামে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত এক অভিভাবক জানান, ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি তিনি সমর্থন করেন না। 'আমি আমার ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করছি। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালাতে মাঝে মাঝে আমাকে ধারও করতে হয়। রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ থাকলে বড় ক্ষতি হবে। তাই আমি কখনোই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সমর্থন করব না।'
বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাদের দিক থেকে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে না দেওয়ার অবস্থানে অনড় রয়েছে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের ছাত্র রাজনীতি করতে দেবে না।
তিনি বলেন, 'ক্যাম্পাসের বাইরে তারা তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের চর্চা করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
'অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী রাজনীতির অনুমতি না দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় সদস্য। ভালো ও শান্তিপূর্ণ একাডেমিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আমরা সবকিছু করব।'
রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা এখনই বলতে পারছি না। তবে বলতে পারি, কোনো মূল্যেই কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেব না।'
নাম না প্রকাশের শর্তে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরিচালক টিবিএসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে ছাত্ররাজনীতি করার অনুমতি দেয় না, তবে তারা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক পছন্দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
এ পর্যন্ত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের ভেতর কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেবে না। তবে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের চর্চা করতে পারে।
এপিইউবির সভাপতি শেখ কবির হোসেন সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'আমরা কখনোই রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করি না...তবে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কার্যক্রম চালাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা [তাদের] রাজনীতি নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
'আমরা আশা করি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নীতি ও শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।'
এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়।
অসংখ্য মহল ঘোষণাটির সমালোচনা করে বলে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখাই ভালো হবে।
ছাত্রলীগ এর আগেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল।
ছয় বছর আগে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এই উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'যেখানে ক্যাম্পাস আছে, সেখানেই ছাত্রলীগের কমিটি হবে।'
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ আর বাস্তব রূপ নেয়নি।
ছাত্রলীগের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হাকিম টিবিএসকে বলেন, ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, 'আমি অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার বিশ্বাস, তারা আমাদের অনুরোধ বুঝবে, কারণ রাজনীতি আমাদের মৌলিক অধিকার। এমনকি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট-২০১০-ও ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেনি, বরং সমর্থন করে।'
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট-২০১০-এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে এতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিলসহ আরও কিছু কমিটি গঠন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে অন্তর্ভুক্ত নয় এমন কোনো কমিটি গঠন করতে চাইলে চ্যান্সেলরের অনুমোদন প্রয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর টিবিএসকে বলেন, ইউজিসি এখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখছে না। 'কোনো জটিলতা দেখতে পেলে আমরা নির্দেশনা দেব।'
তিনি বলেন, ইউজিসি দেখেছে ছাত্রলীগ কয়েকটি কমিটি গঠন করেছে, তবে এতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মতি আছে কি না তা জানা দরকার।
'আমাদের বার্তা স্পষ্ট—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের একাডেমিক কার্যক্রম প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট-২০১০ অনুযায়ী পরিচালনা করবে,' বলেন তিনি।