দক্ষিণীরা ভারতের অন্য অংশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কেন?
তথ্য বলছে, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলোর এই সাফল্যের রহস্য কী? জানাচ্ছেন ডাটা সায়েন্টিস্ট নীলকান্ত আর।
ধরুন, ভারতে একটি কন্যাশিশুর জন্ম হলো।
সেক্ষেত্রে মেয়েটির উত্তর ভারতে জন্মানোর সম্ভাবনা বেশি হবে। কেননা দক্ষিণ ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উত্তরের চেয়ে কম।
তবে এখানে আমরা ধরে নিলাম, মেয়েটি দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজ্যে জন্মেছে। সেক্ষেত্রে বয়স এক বছর হওয়ার আগে তার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক অনেক কম। কারণ দেশের বাকি অংশের চেয়ে দক্ষিণ ভারতে শিশুমৃত্যুর হার কম।
দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেওয়া এই কন্যাশিশুর টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি; তাকে জন্মদানের সময় তার মায়ের মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। এছাড়া মেয়েটির শিশুসেবা ও তুলনামূলক ভালো পুষ্টি পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
এছাড়া কন্যাশিশুটি পঞ্চম জন্মদিন পালন করতে পারবে, অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা ডাক্তার দেখাতে পারবে এবং তুলনামূলক দীর্ঘায়ু হবে—এ সম্ভাবনাও বেশি।
দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেওয়া মেয়েটির স্কুলে, এমনকি কলেজে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। জীবিকা উপার্জনের জন্য তার কৃষিকাজে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা কম; বেশি বেতনের চাকরি করার সম্ভাবনা বেশি।
তাছাড়া মেয়েটি কম সন্তানের জন্ম দেবে। ফলে তার সন্তানরা হবে স্বাস্থ্যবান, শিক্ষার সুযোগ পাবে বেশি। আর ভোটার হিসেবে নির্বাচনের ওপর তার প্রভাবও হবে বেশি।
মোদ্দা কথা হলো, দক্ষিণ ভারতে জন্ম নেওয়া একটি শিশু উত্তর ভারতে জন্ম নেওয়া শিশুর চেয়ে তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর, সচ্ছল, নিরাপদ ও সামাজিকভাবে প্রভাবপূর্ণ জীবনযাপন করবে।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সুযোগের অনেকগুলো সূচকে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের পার্থক্যটা ঠিক ইউরোপ ও সাব-সাহারান আফ্রিকার মধ্যকার মতোই।
কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের এই পার্থক্য শুরু থেকেই ছিল না।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্য—তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরালা ও অন্ধ্র প্রদেশ ছিল উন্নয়নের দিক থেকে একেবারে তলানিতে। এই চার রাজ্যে ভারতের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের বাস ছিল। (২০১৪ সালে অন্ধ্র ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন করা হয়)।
কিন্তু ১৯৮০-র দশকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ইতিবাচকভাবে বদলাতে শুরু করে। সেই ধারা আজও বজায় আছে।
এমনটা কী করে বা কেন ঘটল—এ প্রশ্নের উত্তর একটি নয়, অনেকগুলো।
ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলোর প্রত্যেকেরই নিজেদের গল্প আছে। তবে দক্ষিণের এই উন্নতি এসেছে প্রতিটি রাজ্যের উদ্ভাবনী নীতিমালার বদৌলতে।
এর মধ্যে কিছু নীতি কাজ করেছে। কিছু ব্যর্থ হয়েছে। আবার কিছু নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শুধু শুধু টাকা গচ্চা গেছে। তবে অনেকেরই বিশ্বাস, দক্ষিণের রাজ্যগুলো গণতন্ত্রের পরীক্ষাগার হিসেবে কাজ করেছে।
এর একটি অন্যতম উদাহরণ হলো মিড-ডে মিল বা মধ্যাহ্নভোজ প্রকল্প। এ প্রকল্পে সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়। এই প্রকল্প প্রথম নেওয়া হয়েছিল তামিলনাড়ুতে, ১৯৮২ সালে।
মিড-ডে মিল স্কিম তামিলনাড়ুর স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বাড়ায়। বর্তমানে স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির দিক থেকে প্রথম এই রাজ্যটি।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, তামিলনাড়ুর প্রতিবেশী কেরালার স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অগ্রগতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে রাজ্যটির রাজনৈতিক সংহতি ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রেরণা সিং উপজাতীয়তাবাদকে এই অগ্রগতির নেপথ্যের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তবে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর সাফল্য একটি বিশেষ সমস্যাও তৈরি করেছে।
দক্ষিণের চার রাজ্যের জনসংখ্যা উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর চেয়ে কম। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এক প্রজন্ম ধরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম।
জনসংখ্যা কম হওয়ায় দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোকে মাথাপিছু হিসেবে বেশি কর দিতে হয়। কিন্তু এই রাজ্যগুলোর জন্য বরাদ্দ থাকে কম। কেননা কেন্দ্রে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া দেওয়া হয় জনসংখ্যার পরিমাণের ভিত্তিতে। ফলে একদিক থেকে সাফল্য তাদের জন্য শাস্তি হয়ে উঠেছে বলে মনে করে দক্ষিণ ভারতের রাজগুলো।
অনেকের বিশ্বাস, সাম্প্রতিক কর সংস্কারের কারণে এই অবস্থা খারাপের দিকে গেছে।
অতীতে ভারতের সব রাজ্যই পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়াত। এর সুবাদে তারা নিজস্ব নীতি—যেমন তামিলনাড়ুর মিড-ডে প্রকল্প—প্রণয়নের আর্থিক স্বাধীনতা পেত। কিন্তু সারা দেশকে একটি একক বাজারে একীভূত করা জন্য পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) প্রবর্তনের পর রাজ্যগুলো বলছে, তাদের নিজস্ব অর্থ সংগ্রহ করার সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে এসেছে। এবং অর্থের জন্য তারা ক্রমেই কেন্দ্র সরকারের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি তামিলনাড়ুর অর্থমন্ত্রী পি ত্যাগরাজন বলেছিলেন, 'রাজ্যগুলো থেকে করের সমস্ত ভ্যারিয়েবল সরিয়ে দিয়ে সেগুলোকে জিএসটি বাকেটের আওতায় নিয়ে এলে রাজ্যগুলো তাদের রাজস্বনীতি নির্ধারণ করবে কোথায়? রাজ্যগুলোকে কার্যকরভাবে পৌরসভায় পরিণত করা হয়েছে।'
এই মন্তব্যের পর কেন্দ্রীয় সরকার ও দক্ষিণের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
যেমন, জিএসটি নিয়ে দিল্লি ও রাজ্যগুলোর মধ্যে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই চলার পর কয়েকটি রাজ্য সরকার মামলা করার হুমকি দিলে অবশেষে ২০২০ সালে কেন্দ্র সরকার রাজ্যগুলোকে আইনত তাদের পাওনা পরিশোধ করতে রাজি হয়।
চলতি বছরের গোড়ার দিকে জ্বালানির দাম কমানো নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই।
একদিকে উত্তরপ্রদেশের মানুষ তামিলনাড়ুর নাগরিকদের মতো সরকারি পরিষেবা ও কল্যাণ প্রকল্পের সুবিধা পেতে চায়। কিন্তু অন্যদিকে তামিলনাড়ুর কিছু নাগরিক জটিল কর ব্যবস্থার ফলে নিজেদের পেছনে যত খরচ করেন, তারচেয়ে বেশি অর্থ উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে পাঠাতে বাধ্য হয়।
এখানেই শেষ নয়—দক্ষিণ ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও জটিল রূপ নিতে পারে। ২০২৬ সালে দক্ষিণের রাজ্যগুলো আরেকটি ধাক্কা খেতে পারে। ওই বছর আরেকটু সীমিত হয়ে আসতে পারে তাদের গণ্ডি।
২০২৬ সালে জনসংখ্যা পরিবর্তনের অনুপাতে ইলেকটোরাল আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হবে। এর অর্থ, একাধিক বৈরিতার মুখে পড়বে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো। এতদিন তাদের রাজস্ব আয় কমেছে, নিজেদের নীতি প্রণয়নের স্বাধীনতাও ছিল না। এবার পার্লামেন্টে সমৃদ্ধ দক্ষিণের আসনসংখ্যাও কমে আসতে পারে।
- সূত্র: বিবিসি