সরকারের ডলার সংকট ও ব্যয় সংকোচন নীতিতে আমদানি ও গাড়ি বিক্রি কমে লোকসানের ঝুঁকিতে প্রগতি
ডলার সংকটসহ সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি কেনা বন্ধ করে দেওয়ায় লোকসানের ঝুঁকিতে পড়েছে এক দশক ধরে মুনাফা অর্জনকারী দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অটোমোবাইল সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
একই সঙ্গে ডলার সাশ্রয়ে আমদানি ব্যয় কমাতে গাড়িসহ বিলাসবহুল পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ফলে প্রতিষ্ঠানটির গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের তথ্যমতে, প্রগতি প্রতি বছর ৯০০টির বেশি গাড়ি বিক্রি করে। এমনকি কোভিড কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরেও ৭১১টি গাড়ি বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে কোভিডের মাঝেও ২০২০-২১ অর্থবছরে গাড়ি বিক্রি হয় মাত্র ৩৪২টি। তবে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি ক্রয় বন্ধ করে দেওয়ায় প্রগতির গাড়ি বিক্রি একেবারে কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিমাসে গড়ে ৭০টির বেশি গাড়ি বিক্রি করে। কিন্তু চলতি অর্থ বছরের গেল আড়াই মাসে প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি বিক্রি হয়েছে মাত্র ২২ টি।
একইভাবে প্রতিবছর এক হাজার গাড়ির পার্টস আমদানি করে প্রগতি। প্রতি চালানে ২০০ গাড়ির পার্টস হিসেব করে বছরে কমপক্ষে পাঁচবার গাড়ি আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২০০ গাড়ির আমদানির ঋণপত্র খোলে। এরপর গত আট মাসে আর কোনো পার্টস আমদানি করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
গত ৩ জুন জারি করা এক পরিপত্রে সরকার বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সব ধরনের মোটরযান, জলযান ও আকাশযান কেনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এতে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার ব্যয় সংকোচনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কিছু খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে চলতি বছরে লোকসানের আশঙ্কা থেকে সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যূনতম সংখ্যায় হলেও গাড়ি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ। কিন্তু প্রগতির এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ায় লোকসানে ঝুঁকিতে পড়েছে প্রগতি।
সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রগতি করপূর্ব মুনাফা করেছে ৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) এর পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৬ কোটি ২ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০১ কোটি ৩৩ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৫ কোটি ৪৯ লাখ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা করপূর্ব আয় করেছে প্রগতি।
এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক ৯০০টি গাড়ি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৪৮টি গাড়ি বিক্রি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। চলতি অর্থবছরে এক হাজার গাড়ি উৎপাদন ও বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতির কারণে লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশই অর্জন হবে না বলে মনে করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
প্রগতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, প্রগতির প্রধান ক্রেতা সরকারি প্রতিষ্ঠান। করোনা মহামারি চলাকালেও সরকারি কোষাগারে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের পাশাপাশি লাভের ধারায় ছিল প্রগতি। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে যানবাহন ক্রয় বন্ধ থাকায় চলতি অর্থবছরে প্রগতি কিছুটা সংকটে রয়েছে। তবে দেশে সংকট কেটে গেলে প্রগতি ঠিকই আগের মতোই ঘুরে দাঁড়াবে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ 'মেড ইন বাংলাদেশ' গাড়ি তৈরির মাধ্যমে বিশ্বে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে গাড়ি বিক্রির ওপর নির্ভরশীল থাকায় লোকসানের ঝুঁকিতে পড়েছে প্রগতি। একটি টেকসই ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে গেলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও প্রাধান্য দিতে হবে। বর্তমান সংকটকালেও বেসরকারি গাড়ি সংযোজনকারী কোম্পানিগুলো দেশে যেভাবে ব্যবসা করছে, সেখানে প্রগতি শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় লোকসানের ঝুঁকিতে পড়েছে। এজন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিপণন দক্ষতা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দেয়া জরুরি।
প্রায় এক দশক ধরেই মুনাফায় রয়েছে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) অধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ। বিশ্ববাজার থেকে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে সংযোজনের মাধ্যমে বিপণন করে প্রতিষ্ঠানটি। চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডে স্থাপিত প্রগতির গাড়ি সংযোজন কারখানার সক্ষমতা বছরে ১ হাজার ৩০০টি। নিয়মিত ৯০০ থেকে ১,০০০ গাড়ি সংযোজন ও বিপণন করে প্রগতি। তবে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের হার কমে যায়। কমে যায় সরকারি কাজে গাড়ি কেনার পরিমাণও। করোনার প্রকোপ কমার পর গাড়ি বিক্রি শুরু হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলার সংকটসহ নানা জটিলতায় কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটতে থাকে সরকার। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কেনা ফের বন্ধ হয়ে যায়।
ইংল্যান্ডের জেনারেল মোটরসের কারিগরি সহযোগিতায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাড়বকুণ্ডে ১৯৬৬ সালে ব্যক্তিমালিকানায় গাড়ি সংযোজন কারখানা হিসেবে গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (পিআইএল) নামে জাতীয়করণ করা হয়। পরবর্তীতে তা শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) অধীনে ন্যস্ত করা হয়।