চীনের ভুল মানেই আমেরিকার পোয়াবারো!
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চীন-অধিপতি হয়েই থাকবেন হয়তো শি জিনপিং। কারণ, তিনি ব্যতিক্রম করছেন।
গত কয়েক দশক ধরে নিয়মিত বিরতিতে শীর্ষ নেতৃত্ব বদলেছে চীনের সমাজতান্ত্রিক দল, যা ছিল দেশটির সাফল্যের চাবিকাঠি। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, শি জিনপিং-ও সরে দাঁড়াতে পারতেন। তার প্রশাসনকে প্রতিস্থাপনও করতে পারতো নতুন টিম।
কিন্তু, সরে দাঁড়ানোর বিপক্ষে শি জিনপিং। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও গভীর। আর সে জন্যই দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ একচুলও আলগা করেননি।
তাই আগামী ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় সমাজতান্ত্রিক দলের ২০তম পার্টি কংগ্রেসে শি জিনপিংকে আরও পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করা হতে পারে বলে বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকই মনে করছেন।
প্রথা ভেঙে শি আজীবন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করবেন– এই বিষয়টি অনেক বছর আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। শি জিনপিং এর নেতৃত্বেই আমেরিকার সম্ভাবনাময় অংশীদার থেকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছে চীন। তাই আগেভাগে জানা সত্ত্বেও- এ ঘটনা ওয়াশিংটনের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের মেরুদণ্ড হিমকারী বার্তাই দেবে।
সাম্প্রতিক দু-তিন দশকে চীন বিপুল সম্পদ অর্জন করেছে। এ সম্পদ পুঁজি করে আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রাধান্য, প্রযুক্তিগত অগ্রগামীতা এবং সামরিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বদ্ধপরিকর চীনের এ সর্বোচ্চ নেতা।
এমনকী বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যার ভিত্তিই আমেরিকার শক্তি– তাতেও আমূল বদল চায় শি'র চীন। ফলে শি জিনপিংয়ের আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অর্থ– আরও পাঁচ বছর দুই পরাশক্তির তীব্র প্রতিযোগিতার কাল। আর হয়তোবা সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাওয়ারও সময়।
এসব ব্যাখ্যা খুবই সাধারণ। বেশিরভাগ মানুষই তা জানেন। তবু শি জিনপিংকে আরেক মেয়াদ থেকে যাওয়ার জন্য আমেরিকা ধন্যবাদ জানাতেই পারে।
কেন জানাবে? যখন চীন অধিপতি চান– আমেরিকার বৈশ্বিক প্রতিপত্তির অন্ত। আসলে জানাবে এজন্য যে, এই বিশাল লক্ষ্য অর্জনের জন্য চীনকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করেননি শি। তার নীতির ফলে আমেরিকার প্রতিযোগী হিসেবে– চীন দুর্বল হয়েছে, শক্তিশালী হয়নি।
শি যতদিন চীনের কাণ্ডারি থাকবেন, দেশটির প্রতিযোগী সক্ষমতা হয়তো ততটাই কমতে থাকবে।
যদিও এটাও ঠিক– চীনের উত্থান নিয়ে গত এক দশকে যত ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে– তাতে চাপা পড়েছে নানান ক্ষেত্রে শি জিনপিং দুর্বল দিকনির্দেশনা। ফলত গতি হারিয়েছে চীনা অর্থনীতি। একদা প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাকে চীনে বেদবাক্যের মতো অনুসরণ করা হতো, সেই ধারাবাহিকতা থেকে সরে এসেছে শি'র প্রশাসন।
শি'র আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বদৌলতে শঙ্কিত চীনের এশীয় প্রতিবেশীরা, আর বেশিরভাগ বিশ্বশক্তি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। তার উচ্চ পর্যায়ের সরকারি প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ রূপ নিয়েছে অপচয় ও অব্যবস্থাপনায়।
যদিও শি বলেন, বিশ্বস্তরে চীনের উত্থান ছিল অবশ্যসম্ভাবী– আর তা নিশ্চিত হচ্ছে তার শাসনের হাত ধরে। এই বিকল্প আখ্যানই আমেরিকার পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রনীতির পক্ষে গুরুতর সমস্যার জন্ম দেয়। তার এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের ফলেই– কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামরিক ও আদর্শিক– প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনকে মোকাবিলায় উদ্যমী হয়ে ওঠেন ওয়াশিংটনের কর্তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন চিপস বিল সই করেছেন। এর মাধ্যমে চীনের হাতে গুরুত্বপূর্ণ সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি যাতে কোনোভাবেই না যায় তা নিশ্চিত করতে চায় আমেরিকা। চীনকে ঠেকানোর পূর্ব আলোচিত নীতির আলোকেই পাস হয়েছে এ বিলটি।
এই চিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ২০২১ সালে 'বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড' কৌশল নেন বাইডেন। এর আওতায় চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' উদ্যোগের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করবে আমেরিকা।
শি জিনপিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে চীনের সামর্থ্যের সামঞ্জস্য আছে – এই ধারণাপ্রসূত হয়েই নেওয়া হয়েছে এসব নীতি। কিন্তু, এখন নানান ঘটনায় প্রমাণ হচ্ছে– এসব লক্ষ্য টেকসইভাবে বাস্তবায়ন চীনের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে।
তাই বলা যেতে পারে– শি জিনপিং এর অতি-প্রচেষ্টা ওয়াশিংটনের জন্য আশীর্বাদ। মার্কিনীরা যখন দলীয় অনৈক্য আর সামাজিক বিশৃঙ্খলায় ভুগছে– তখন দুর্বল চীন হচ্ছে সহজ লক্ষ্যবস্তু। অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকেও আমেরিকানদের নজর সরিয়ে রাখা যাচ্ছে। চীনের সাথে মেকি পরাশক্তি প্রতিযোগিতাকে সামনে রেখে ঐক্যের সুযোগ পাচ্ছেন– রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট নেতারা।
অবশ্য একথাও ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত বর্তমান সময়েই সবচেয়ে দুর্বল আমেরিকার বৈশ্বিক পরাভব। এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে নীরবে আমেরিকাকে খর্ব করে চীনের প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন শি জিনপিং। কিন্তু, তিনি সতর্ক হওয়ার ধারেকাছেও যাননি। ফলে আমেরিকা পরাশক্তির এই মল্লযুদ্ধে শুধু নতুন উদ্যমেই ফিরে আসেনি, বরং আরও শক্তিশালীভাবে ফিরেছে। বৈশ্বিক পর্যায়েও নিজের অবস্থান ঝালাই করে নিচ্ছে। যেখানে প্রয়োজন দৃঢ় করছে।
মার্কিন মিত্রতার বৈশ্বিক জোট বছর কয়েক আগেও ছিল ভাঙন ও বিভাজনের মুখে। চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলা সামনে রেখে ঘুচেছে সে বিভাজন। শি জিনপিং এর নীতির সুবাদেই– পশ্চিমারা এখন আরও বেশি শক্তিশালী।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে দুর্বল করার মতো ইচ্ছে ও সম্পদ আছে– এমন হুমকি হিসেবে এখনও রয়েছে চীন। কিন্তু, চীনের উত্থান অপ্রতিরোধ্য, আর আমেরিকার পতন অবশ্যসম্ভাবী– এই ধারণা যে অতি-সরলীকরণের মতো ভুল– তাই প্রমাণ করেছে শি জিনপিং এর এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যর্থতা।
শি চান 'প্যাক্স-আমেরিকানা' বলা যায় এমন এক যুগের অবসান। আর এই যুগের অন্ত সূচনাকারী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে তারই নাম। কিন্তু, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো মার্কিন আধিপত্যবাদকে রক্ষাকারী হিসেবেই তার নাম লেখা হবে।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক থেকে সংক্ষেপিত