এখনো একমেবাদ্বিতীয়ম সুমন!
বয়সের কোঠা সত্তর পেড়িয়েছে আগেই। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়েছে। নিজে থেকে বসতে কিংবা উঠতে পারেন না। শরীরে বাসা বেঁধেছে একাধিক জটিল রোগ, তারপরও কণ্ঠের মাধুর্যতা কমেনি এতোটুকুও। বরং আরও শানিত হয়েছে গানের গলা। অসুস্থ শরীর নিয়েও কীবোর্ড বাজাচ্ছেন নিয়মিত। তিনি কবীর সুমন। ভারতের কলকাতার কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে কিংবা বাংলা ভাষাভাষী সংগীত পিপাসুদের এক আরাধ্য সংগীতজ্ঞ তিনি।
দীর্ঘ সময় পর ঢাকার শ্রোতাদের গান শোনাবেন, এমন খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই তাকে নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয়। দর্শনীর বিনিময়ে সরবরাহ করা টিকেট নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান পিপহোলকে তাই বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে।
১৫ অক্টোবর বিকাল ৫টায় অনুষ্ঠান শুরু হয় রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে। তবে অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগে থেকেই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানস্থল। কেউ কেউ টিকেট না পেয়ে হতাশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। তাছাড়া অনুষ্ঠানের ভেন্যু নিয়েও এক ধরনের জটিলতা তৈরী হয়েছিল। সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সুমন মঞ্চে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হলভর্তি দর্শক উল্লসিত হয়ে ওঠেন।
কবীর সুমন শ্রোতাদের অভিবাদন জানিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি আনন্দে মেতে ওঠেন। 'কেমন আছেন সবাই' কথাটির বলার পরপরই শ্রোতারা এর জবাব দেন। 'এক একটা দিন' গানটি দিয়ে শুরু করেন পরিবেশনা। গানটি শেষ করে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। সর্বশেষ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মঞ্চে গান করেছিলেন। সেই স্মৃতির কিছুটা দর্শকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সুমন। এরপর 'কাবেরী নদী জলে', 'জাগে জাগে জাগে রাত' গান গেয়ে আবারও আলাপনে মশগুল হয়ে পড়েন। শ্রোতারা তার গান যেভাবে আবিষ্ট হয়ে শুনছিলেন, তার গল্প-আলাপেও সমান আনন্দ পান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুনসুটি করতেও ভোলেন নি। এরপর 'পুরনো সেই দিনের কথা' গাওয়ার সময় শ্রোতারা তার মুখ থেকে গানটি ছিনিয়ে নিয়ে সবাই সমস্বরে গাইতে থাকেন। পুরো অনুষ্ঠানস্থল হয়ে ওঠে সংগীতময়।
কবীর সুমন বলেন, 'আমরা বাঙালিরা বেশ স্মৃতিকাতর। সবারই কম-বেশি স্মৃতি সংরক্ষিত আছে মনের মধ্যে। বাংলাদেশে আমার অনেক অম্লমধুর স্মৃতি আছে। জীবন সায়াহ্নে এসে তাই আমিও স্মৃতির জানালা খুলে দেখি কতশত মুখ ভেসে উঠছে। কেউ দুনিয়া ছেড়ে গেছেন, আবার অনেকেই আমার মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টিকে আছেন। এভাবে কী আসলে বেঁচে থাকা যায়। তারপরও বেঁচে আছি। কতদিন থাকব তা তো জানিনা।'
এগুলো বলেই আবারও গানে মনোনিবেশ করেন সুমন। 'হাল ছেড়োনা বন্ধু' গানের পর পরিবেশন করেন, 'প্রিয়তমা, তোমাকে অভিবাদন'। এই গানটি গাওয়ার ফাঁকে এটির গীতিকার কবি শহীদ কাদরীর কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, 'এটি ছিল মূলত একটি কবিতা। আমি শহীদ কাদরীকে আগে থেকেই না জানিয়ে গানটির সুর ও সংগীত করি। পরে গানটি কণ্ঠে তোলার পর শহীদ কাদরীকে জানালে তিনি অবাক হয়ে বলেন "এটা দিয়েও কি গান হয়"। পরে যখন গানটি প্রকাশ হয়, তখন থেকে এখন পর্যন্ত শ্রোতাদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পাচ্ছি।' এরপর 'কখনও সময়', ' সুফিয়া কামাল', 'বাংলার ধনুকের', 'যদি ভাব কিনছ আমায়', 'শীষ পাড়ানী', 'বন্ধু কি খবর বল', 'মন খারাপ করা বিকেল' 'বয়স আমার' গানগুলো গেয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের বিমোহিত করে তোলেন। তার সঙ্গে যন্ত্রসংগীতে সঙ্গত করেন ধ্রুব বসু রায়, ইন্দ্রজিৎ প্রধান ও বিশ্বজিৎ রায়।
গানের ফাঁকে ফাঁকে তার আলাপগুলোও ছিল তথ্যে ভরপুর। যেমন তিনি আধুনিক গানের শিল্পী হলেও বাংলা খেয়ালের ওপর রয়েছে তার অসাধারণ দখল। এ প্রসঙ্গে সুমন বলেন, "আমি আসলে অন্যান্য গানের তালিম নেয়ার পাশাপাশি খেয়াল নিয়ে কাজ করছি অনেক আগে থেকেই। তবে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি সেভাবে। যারা আমার এই পারদর্শিতার কথা জানেন, তারা হয়ত আমার কাছের মানুষ কিংবা স্বজন। তবে আমি আগামী ১৮ অক্টোবর এখানে এই মঞ্চেই আমি খেয়াল পরিবেশন করব। সেই আয়োজনেও সবার উপস্থিতি চাই। কারণ এরপর আর এভাবে অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য হয়ত সুযোগ নাও পেতে পারি। আশা করছি উপভোগ্য একটি অনুষ্ঠান হবে সেটি", কথাগুলো বলেই আবেগতাড়িত হন তিনি। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে গানে মনোনিবেশ করেন।
এদিকে অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ঘটে এক অন্য ঘটনা। বন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন সুমন। ঢাকায় তার এক বন্ধু আছে। শাহজাহান ফারুক। তার সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেন সুমন। সেই বন্ধুটির সঙ্গেও নাকি তার দেখা নেই অনেক বছর। সুমন দুষ্টুমির ছলে বন্ধু শাহজাহান ফারুকের নাম ধরে ডাক দেন। সবাইকে অবাক করে তিনি দর্শক সারি থেকে হাত তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। পরে সেই বন্ধুকে মঞ্চে নিয়ে আসেন সুমন। দুই বন্ধুর আলিঙ্গনের এই দুর্লভ মুহূর্ত শ্রোতারা করতালি দিয়ে উৎসাহিত করেন। সুমন বন্ধুকে সামনে রেখে বলেন, "আমাদের এই দেখা হওয়ার বিষয়টি মোটেও পরিকল্পিত নয়। আমি জানতাম শাহজাহান ফারুক ঢাকাতেই আছে। কিন্তু এভাবে যে সে আমাকে চমকে দেবে তা আমার ধারণাতেই ছিলো না।"
বন্ধুর বিদায়ের পর আরও কয়েকটি গান পরিবেশন করেন তিনি। সবশেষে 'তোমাকে চাই' শিরোনামের গানটি গেয়ে অনুষ্ঠানের ইতি টানেন কবির সুমন। কবির সুমনের জনপ্রিয় গান 'তোমাকে চাই'-এর ৩০ বছর উদযাপন উপলক্ষে 'ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই' শিরোনামে সংগীত আসরের আয়োজন করে পিপহোল নামের একটি সংস্থা। প্রসঙ্গত, আগামী ১৮ ও ২১ অক্টোবর একই জায়গায় গাইবেন কবির সুমন। এরপর ফিরে যাবেন কলকাতায় নিজের আবাসে।