মূল্যস্ফীতিতে যেভাবে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে
ব্যাংক আমানতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে ক্রমবর্ধমান পণ্যমূল্য। কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খরচ মেটানোর পর মানুষের হাতে বলতে গেলে ব্যাংকে রাখার মতো টাকাই থাকছে না। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমানতের টাকা ভেঙে ভেঙেও খাচ্ছেন অনেকে।
এর ওপর ডলার ক্রয়ে ব্যাংকগুলোর ব্যয় এবং বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ দুটোই বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং সিস্টেমে ব্যাপক তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।
এ সংকট উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যংকগুলোর ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। একইসঙ্গে স্বল্প সময়ে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের টাকা ধার নেয়া 'কল মানি রেট' অধিক পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, চলতি বছরের আগস্টে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.৮ শতাংশ কমে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও মেয়াদি আমানত (টাইম ডিপোজিট) ও চাহিদা আমানত (ডিমান্ড ডিপোজিট) লক্ষণীয়ভাবে কমছে।
মেয়াদি আমানতের অর্থ একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। অন্যদিকে চাহিদা আমানতের অর্থ কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত জমা রাখার বাধ্যবাধকতা নেই; চাহিদা আমানত থেকে যেকোনো সময় টাকা উত্তোলন করা যায়।
চলতি বছরের জুলাই মাসে মোট চাহিদা আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে আগস্ট শেষে চাহিদা আমানতের পরিমাণ কমে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
ব্যাংকাররা বলছেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের কথা ভেবে মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা না রেখে হাতে নগদ অর্থ রাখতে চাইছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলোও বেশি সুদের হারে আমানত রাখতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
সংকট মোকাবিলায় নগদ অর্থ সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে।
চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। অথচ গত বছরের এই সময়ে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার মতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক কল মানি রেটও সম্প্রতি অধিক পরিমাণ বেড়েছে।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতি
কয়েক মাস ধরেই টানা মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫ শতাংশ, যা গত ১২ বছরে সর্বোচ্চ। পরের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৯.১ শতাংশ হয়েছে।
ওই দুই মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছড়িয়ে গেছে।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১.৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গত ২০ বছরে একসঙ্গে এত বেশি পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর রেকর্ড আর নেই। তাই আগস্টের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে।
এছাড়া পরিবহন, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রীর মতো খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার দামও বাড়তে শুরু করে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসবেরই প্রভাব ব্যাংকিং খাতের আমানতের ওপর পড়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ডলার খরচ হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে ডলার কিনতে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে বলে তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তারল্য সংকট দেখা দেওয়ায় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অধিক পরিমাণে টাকা ধার নিচ্ছে।
চাপে আছে তারল্য
চলতি বছরের আগস্ট মাসের শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। দুই মাস আগেও এ খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, এ বছরের জুলাইয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার দেখা গেছে ৮ শতাংশ, অথচ ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। এছাড়া ডলার বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া ঋণের সুদহার না বাড়ানোর কারণে অনেকেই সহজে ঋণ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংখট দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মনসুর বলেন, এ সংকট উত্তরণে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া। এছাড়া যেকোনোভাবে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সরবরাহ করার ওপরও জোর দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি বেড়েছে
সূত্রমতে, ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম থকায় প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে বাজার থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চলে গেছে।
এছাড়া আগের অর্থবছরে ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঢোকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
ঊর্ধ্বমুখী বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি
আমনত কমলেও ডলারের দাম ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে গত পাঁচ মাস ধরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী।
অর্থপ্রবাহে লাগাম টানতে চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বসীমা কিছুটা কমিয়ে ১৪.১ শতাংশ করেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪.৮ শতাংশ ছিল। কিন্তু তারপরও আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৪.০৭ শতাংশ হয়ে যায়, যা ৪৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটের কারণে সরকারও ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের শেষে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো আগের ঋণের ৭ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার।