ভয়ঙ্কর ইরানি ড্রোন: কেন ইউক্রেন যুদ্ধে ধবংসযজ্ঞ ঘটাচ্ছে, ব্যাখ্যা দিলেন ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ
পশ্চিমাদের কাছে কুখ্যাতি আর বৈশ্বিক অস্ত্র বাজারে খ্যাতি– দুইই অর্জন করেছে ইরানের তৈরি ড্রোন। এগুলি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল বা চীনের তৈরি ড্রোনের মতো প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর না হলেও রাশিয়া এ সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে ইউক্রেনীয় লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সফলভাবেই ব্যবহার করছে। খবর ইউরেশিয়ান টাইমসের।
গত ১০ অক্টোবর ইউক্রেনের রাজধানীতে প্রথমবারের মতোন ইরানের তৈরি আত্মঘাতী দিয়ে ড্রোন হামলার কথা জানা যায়। এরপর ১৭ তারিখেও আকাশপথ দিয়ে একের পর এক হামলায় কেঁপে উঠে কিয়েভ। ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে শাহিদ-১৩৬ ড্রোনও ব্যবহার করে রাশিয়া। এই ড্রোন কিয়েভের শক্ত আকাশপ্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করেও ত্রাস সঞ্চার করে। ড্রোনের আঘাতে মারা যায় অন্তত ৪ কিয়েভবাসী।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই আবাসিক ভবন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্যুয়ারেজ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট, সেতু, খেলার মাঠ ইত্যাদি অবকাঠামোতে আঘাত হেনেছে শত শত ইরানি কামিকাজে ড্রোন।
ইরানের তৈরি যেসব ড্রোন রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যবহার করছে
বিগত এক দশকে ড্রোন প্রযুক্তিতে দারুণ অগ্রগতি করেছে ইরান। হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান ড্রোন পরাশক্তি।
দেশটির কাছে ছোট ও হালকা থেকে শুরু করে– মাঝারি ও তুলনামূলক ভারি মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইএভি) সবই আছে। গুপ্তচরবৃত্তি, সীমান্ত প্রহরা, শত্রুর অবস্থানে নজরদারি বা হামলা– নানান ভূমিকা আছে এসব ড্রোনের।
ইরানের চেয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ সামরিক বাজেট আছে– এমন অনেক দেশের চেয়েও বেশি সংখ্যক অস্ত্রসজ্জিত বা হামলাকারী ড্রোন আছে ইরানের। এই অর্জন দেশটি করেছে লাগাতার পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থেকেও।
শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ইউক্রেনে দুই ধরনের ইরানি ড্রোন ব্যবহার করছে। এগুলি হলো- মোহাজের-৬ ও শাহিদ সিরিজের ইউএভি। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, সরাসরি আক্রমণ বা পরোক্ষ আক্রমণ যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ও আর্টিলারি হামলার জন্য লক্ষ্যবস্তু শনাক্তকরণ– ইত্যাদি কাজে এগুলি ব্যবহার করা যায়।
ইরানের সবচেয়ে আধুনিক ড্রোনের মধ্যে অন্যতম হলো মোহাজের-৬, যা রাশিয়াকে দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে।
মোহাজের সিরিজের সর্বাধুনিক সংস্করণই হলো মোহাজের-৬। এটি ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে, ফলে থাকে অধিকাংশ স্বল্প পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালের বাইরে। ড্রোনটি সর্বোচ্চ পাল্লা অবশ্য কম, মাত্র ২০০ কিলোমিটার। তবে উড়তে পারে টানা ১২ ঘন্টা।
মার্কিন সেনাবাহিনীর ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড (ট্রাডক) ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, মোহাজের-৬ গোয়েন্দা নজরদারি, পর্যবেক্ষণ, লক্ষ্যবস্তু শনাক্তকরণ ও হামলাপূর্ব টহলদারির জন্য অতি-সক্ষম একটি ইউএভি। বহন করতে পারে বহুমুখী নজরদারির জন্য দরকারি সরঞ্জাম, এবং সর্বোচ্চ দুটি গাইডেড বোমা/ ক্ষেপণাস্ত্র।
দুই ডানার নিচে একটি করে, মোট দুইটি অস্ত্র বহনের হার্ডপয়েন্ট আছে মোহাজের-৬ এর। এতে বহন করে কউম টিভি বা আইআর (ইনফ্রারেড) ক্যামেরা-সজ্জিত বোমা। আর আলমাস ক্ষেপণাস্ত্র বহন করা যায় একটি।
সামরিক কিছু সূত্রমতে, মোহাজের-৬ এর আরেকটি ধরন তৈরি করা হয়েছে, যাতে রয়েছে চারটি হার্ডপয়েন্ট। ফলে দুই ডানার নিচে দুটি করে একই রকম মিউনিশন তথা– বোমা/ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারবে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর কৃষ্ণসাগরের আকাশে রাশিয়ার ব্যবহৃত একটি মোহাজের-৬ প্রথমবারের মতো গুলি করে ভূপাতিত করে ইউক্রেন।
অন্যদিকে শাহিদ সিরিজের আওতায় আছে নানান ডিজাইনের ইউএনভি। অ্যারোডায়নামিক নকশাও ভিন্ন ভিন্ন।
ইরানের কাশান বিমানঘাঁটি পরিদর্শনের সময় রুশ কর্মকর্তাদের ছবি তোলে একটি পশ্চিমা স্যাটেলাইট। ওই ছবির সূত্র ধরে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়, রাশিয়াকে শাহিদ-১২৯ এবং শাহিদ-১৯১ ড্রোন দিয়েছে ইরান। কারণ ওই ড্রোনগুলি রুশ কর্মকর্তারা সেখানে দেখেছিলেন।
তবে এপর্যন্ত শুধু শাহিদ-১৩৬ ড্রোন ব্যবহারেরই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই ড্রোনের দাবীকৃত রেঞ্জ আড়াই হাজার কিলোমিটার। বহন করতে পারে ৫ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক।
ইউক্রেন যুদ্ধে মোহাজের-৬ এর ব্যবহার হচ্ছে সীমিত, বেশিরভাগ হামলায় শাহিদ-১৩৬ আত্মঘাতী ড্রোনই ব্যবহার করছে রাশিয়া।
ইরানের আত্মঘাতী ড্রোন ইউক্রেনের জন্য বড় হুমকি কেন?
শাহিদ-১৩৬ কামিকাজে ড্রোন ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীকে।
এই ড্রোনটি একটি নয়, বরং একসাথে অনেকগুলি নিক্ষেপ করছে রাশিয়া। ড্রোনের এ ধরনের দলবদ্ধ আক্রমণকে বলা হয় 'সোয়ার্ম অ্যাটাক'।
ধরা যাক, রাশিয়া পাঁচটি ড্রোনের একটি ঝাঁক নিক্ষেপ করলো। এরমধ্যে দুটিকে হয়তো ইউক্রেনীয় বাহিনী ধ্বংস করতে পারলো, কিন্তু বাকি তিনটি ঠিকই গিয়ে আঘাত করবে লক্ষ্যবস্তুতে। আর হচ্ছেও তাই। দেশটির একজন সামরিক কমান্ডার নাম না প্রকাশের শর্তে স্বীকার করেন বিষয়টি।
এই কৌশলের মাধ্যমে পূর্ব ইউক্রেনের রণাঙ্গন ছাড়িয়ে যুদ্ধাঞ্চলের অনেক পেছনে কিয়েভসহ ইউক্রেনের অন্যান্য সুরক্ষিত শহরে আঘাত হানছে শাহিদ-১৩৬।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, 'সোয়ার্ম অ্যাটাকের' মাধ্যমে শত্রুর অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিয়ে চমকে দিতে পেরেছে রাশিয়া। প্রস্তুতি না থাকায়, ইউক্রেনীয় বাহিনী বেশিরভাগ ড্রোন ভূপাতিত করতেও পারছে না।
সহজে পরিবহনযোগ্য র্যাক বা তাক থেকে একসাথে পাঁচ বা তার বেশি সংখ্যক শাহিদ-১৩৬ ড্রোন নিক্ষেপ করা যায়। এতে টার্গেট শনাক্ত ও ধবংসে হিমশিম খায় শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। একটি আক্রমণের সময় রাশিয়া সর্বোচ্চ ১২টি ড্রোন উৎক্ষেপণ করেছে বলেও জানা গেছে।
যুদ্ধবিমানের দাম অনেক, সস্তা নয় ক্রুজ বা ব্যালেস্টিক মিসাইল। ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ দুর্বল করতে রাশিয়ার দরকার ছিল মিসাইল বা বিমানের মতো কার্যকর– কিন্তু সস্তা অস্ত্রের। যা ধ্বংস হলেও মামুলি লোকসানই হবে।
সেই প্রয়োজন মেটাচ্ছে শাহিদ সিরিজের এসব কামিকাজে ড্রোন। ইউক্রেন যদি এসব ড্রোন ধবংসে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র (স্যাম) ব্যবহার করে, তাহলে তা হবে মশা মারতে কামান দাগার ঘটনা। কারণ, ড্রোনের তুলনায় এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের দাম অনেক বেশি। আর ইউক্রেনের কাছে বর্তমান সংকটকালে এগুলি মহামূল্যবান সম্পদও।
ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর মুখপাত্র ইউরি জানান, শাহিদ-১৩৬ খুব ছোট উড়ন্ত টার্গেট। অধিকাংশক্ষেত্রে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যায় এটি। ফলে সচরাচর রাডারেই ধরা পড়ে না।
আর শনাক্ত করা না গেলে- এগুলি স্যাম দিয়ে ধ্বংস করাও যায় না। মামলা খুবই সহজ। কিন্তু, রাশিয়ার সরল সমীকরণই এখন ইউক্রেনের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে।
এরমধ্যেই ইউক্রেনের বেশকিছু শহরে লাগাতার বোমাবর্ষণে শাহিদ-১৩৬ ড্রোনের ঝাঁক ব্যবহার করা হয়েছে। কের্চ সেতুতে বোমা হামলার পর রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণের অংশ হিসেবে ১০ অক্টোবর কিয়েভও প্রথমবারের মতো শাহিদ-১৩৬ ড্রোনের হামলার শিকার হয়।
শাহিদ-১৩৬ ড্রোনের আঘাতে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে।
ইরানি ড্রোনের প্রসঙ্গে ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ যা বলছেন
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা প্রকৌশলী, বিশ্লেষক উজি রুবিন, বর্তমানে জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটিতে গবেষণা ফেলো হিসেবে যুক্ত আছেন।
তিনি ইউরেশিয়ান টাইমসকে বলেছেন, 'ডিজাইনের কারণেই আক্রমণের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক শাহিদ-১৩৬ আত্মঘাতী ইউএভি'।
ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, শাহিদ-১৩৬ আকারে বেশ ছোট, সহজে প্রস্তুতযোগ্য এবং খুব নিচু দিয়ে উড়তে সক্ষম একটি মনুষ্যবিহীন বিমান। এটি অতি-সাধারণ ইঞ্জিনে চালিত। কাঠের প্রপেলার ইঞ্জিনের সাথে যুক্ত। আর সেই শক্তিতেই এটি উড়ে চলে। দেখতে খেলনা মডেল বিমানের মতো হলেও এটি মারাত্মক এক যুদ্ধাস্ত্র।
উজি রুবিন আরও বলেন, 'এটি পরিচালনা করা সহজ। নিক্ষেপের আগে ইউএভিতে শুধু লক্ষ্যবস্তুর ভৌগলিক অবস্থান আপলোড করে দিলেই হয়। তারপর এটি নিক্ষেপ করা যায়। এর ডানার দৈর্ঘ্য মাত্র ২ মিটার, যা খুবই ছোট বলা যায়। ফলে এটিকে রাডার বা ইলেক্ট্রো- অপটিক সরঞ্জাম দিয়ে শনাক্ত করাও দুষ্কর। আবার নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ রাডারকে ফাঁকি দিতে পারে। প্রপেলারচালিত হওয়ায় এর ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ বা ইনফ্রারেড সিগনেচারও খুবই স্বল্প। তাপসন্ধানী মিসাইল দিয়েও তাই এটি ধ্বংস করা মুশকিল'।
এসব গুণাবলীর কারণেই ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শাহিদ-১৩৬ দিয়ে সৌদি আরবের আবকেইক তেল পরিশোধনাগারে সফল হামলা চালাতে পেরেছিল ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠী। হামলায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হলে, দুই মাস বন্ধ রাখতে হয় স্থাপনাটি।
রুবিন মনে করেন, "রাশিয়ানরা ইরানি অস্ত্রের এসব সুবিধাজনক গুণকেই বুদ্ধিমানের মতো কাজে লাগাচ্ছে"।