লিটন ঝড় ও বৃষ্টির লুকোচুরির পর বাংলাদেশের হৃদয়ভাঙা হার
চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডকে বলা হয় নৈশব্দিক শহর। আবার এটা সংস্কৃতির শহরও। কিন্তু উৎসবের মাঝেও অন্যরকম এক নিভৃতচার যেন এই শহরের আদিমতা। সেই আদিমতা অনেকটাই ভেঙেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগমনে। দুই নভেম্বর এসে আরও ভাঙলো নির্জনতা। অ্যাডিলেড ওভাল হয়ে উঠলো উৎসবের মহল্লা।
শুরুতে স্টেডিয়াম চত্বরে বাংলাদেশ-ভারতের দর্শকদের উন্মাদনা, পরে ২২ গজে চললো লোকেশ রাহুল ও বিরাট কোহলির ব্যাটিং শো। খুনে ব্যাটিংয়ে জবাবটা দারুণ দিলেন লিটন কুমার দাসও। কিন্তু দুর্বার শুরুতে বাংলাদেশ যখন উড়ছে, অ্যাডিলেডে তখনই বৃষ্টির হানা। ৪৫ মিনিট বৃষ্টির পর মেলে নতুন লক্ষ্য। কিন্তু এই শুরুতে আর দাপুটে থাকা হলো না, প্রকৃতির কান্নার পর এবার বাংলাদেশের উইকেটের বৃষ্টি।
একে একে লিটন, শান্ত, সাকিব, আফিফ, ইয়াসির, মোসাদ্দেকদের বিদায়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো জয়ের স্বপ্ন। তাতে রঙ ছিটানোর চেষ্টা করলেন নুরুল হাসান ও তাসকিন আহমেদ, লড়লেন শেষ বল পর্যন্তও। কিন্তু ব্যবধান আর ঘোচানো গেল না। বৃষ্টির হানার পর বৃষ্টি আইনেই মেনে নিতে হলো ৫ রানের হৃদয়ভাঙা হার। তাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনাল খেলার আশাও ফিঁকে হয়ে উঠলো সাকিব আল হাসানের দলের।
বুধবার অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভালে সুপার টুয়েলভের ম্যাচে টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে ভারত। লোকেশ রাহুল ও ম্যাচসেরা বিরাট কোহলির ব্যাটে ৬ উইকেটে ১৮৪ রান তোলে রোহিত শর্মার দল। জবাবে লিটনের খুনে ব্যাটিংয়ে উড়ন্ত সূচনা পাওয়ার পর হানা দেয় বৃষ্টি। ১৬ ওভারে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৫১ রান। এখান থেকে নতুন শুরু করে শেষ পর্যন্ত আর লক্ষ্যে পৌঁছানো হয়নি বাংলাদেশের। সাকিবের দলের ইনিংস শেষ হয় ৬ উইকেটে ১৪৫ রানে।
বড় লক্ষ্য হলেও স্বপ্নের শুরু হয় বাংলাদেশের। লিটনের চোখ ধাঁধানো সব শটে পাওয়ার প্লে থেকে ৬০ রান পায় বাংলাদেশ। ৭ ওভারে আসে ৬৬ রান। লিটন ২৬ বলে ৭টি চার ও ৩ ছক্কায় ৫৯ রান ও শান্ত ১৬ বলে ৭ রান অপরাজিত। এরপর শুরু হয় বৃষ্টি। ৪৫ মিনিট পর নতুন লক্ষ্য মেলে সাকিবদের। তখন ৫৪ বলে ৮৫ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের।
নতুন শুরুর শুরুতেই বাধে বিপত্তি। অষ্টম ওভারের দ্বিতীয় বলে নাজমুল হোসেন শান্তর ডাকে সাড়া দিয়ে দুই রান নিতে গিয়ে হোঁচ খান লিটন। চেষ্টা করেও নিজেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি, এর আগেই রাহুলের থ্রোতে ভেঙে যায় স্টাম্প। ২৭ বলে ৭টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৬০ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেও হতাশ হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় বাংলাদেশের এই ওপেনারকে।
এর আগে মাত্র ২১ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি, যা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দ্রুততম। ২০০৭ বিশ্বকাপে ২০ বলে হাফ সেঞ্চুরি করা মোহাম্মদ আশরাফুল এখনও রেকর্ডটি দখলে রেখেছেন। চলতি আসরে লিটনের হাফ সেঞ্চুরি দ্বিতীয় দ্রুততম এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সব মিলিয়ে যৌতভাবে একাদশতম।
লিটনের হোঁচটে হোঁচট খায় বাংলাদেশও। অবশ্য শুরুতে ধীর গতির ব্যাটিং করা শান্ত হাত খুলে ব্যাটিং করে আশা জাগান। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় কয়েক মুহূর্ত। ২৫ বলে ২১ রান করে ফিরে যান তিনি। এরপর উইকেট পতনের হিড়িক লাগে। সাকিব ১৩, আফিফ ৩ ও ইয়াসির আলী ১ রান করে ফেরেন। দারুণ ছক্কায় শুরু করা মোসাদ্দেকে আশা জাগলেও তিনি ভরসা হয়ে উঠতে পারেননি। ৩ বলে ৬ রান করে আউট হন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।
এরপরও বাংলাদেশ লড়েছে, শেষ বল পর্যন্ত জিইয়ে রেখেছে আশা। শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল ২০ রান। কিন্তু সোহান তোলেন ১৫ রান। ৫ রানের জয়ের উল্লাসে মাসে ভারত। সোহান ১৪ বলে ২টি চার ও একটি ছক্কায় অপরাজিত ২৫ রান করেন। একটি করে চার ও ছক্কায় ৭ বলে ১২ রান করেন তাসকিন। আর্শদীপ সিং ও হার্দিক পান্ডিয়া ২টি করে উইকেট নেন। একটি উইকেট পান মোহাম্মদ শামি।
এর আগে ব্যাটিং করা ভারত শুরুতে সুবিধা করতে পারেনি। বল হাতে শুরুটা দারুণ হয় বাংলাদেশের। মেঘলা আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার ব্যাপারটি কাজে লাগান তাসকিন আহমেদ। প্রথম ওভারে তার খরচা মাত্র ১ রান। যদিও এই ধারায় থাকা হয়নি। দ্বিতীয় ওভারে ৯ রান খরচা করেন সৌম্যর বদলে একাদশে সুযোগ পাওয়া শরিফুল ইসলাম।
তৃতীয় ওভারে সহজ সুযোগ হারায় বাংলাদেশ। তাসকিনের বলে রোহিত শর্মার তোলার সহজ ক্যাচ মাটিতে ফেলেন হাসান মাহমুদ। তরুণ এই পেসার অবশ্য দলকে এই হতাশায় বেশি সময় থাকতে দেননি। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলেই ভারতের অধিনায়ককে নিজের শিকারে পরিণত করেন তিনি।
৩.২ ওভারে স্কোরকার্ডে ১১ রান, নেই এক উইকেট। চাপেই পড়ে যায় ভারত। তবে এই চাপ কাটিয়ে উঠতে সময় নেননি আরেক ওপেনার লোকেশ রাহুল ও বিরাট কোহলি। দ্বিতীয় উইকেটে ৬৭ রানের জুটি গড়ে তোলেন এ দুজন। এর মাঝে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন রাহুল। খারাপ সময় পার করতে থাকা ডানহাতি এই ওপেনার ৩২ বলে ৩টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৫০ রান করে আউট হন।
তাকে ফেরান সাকিব। এরপর কোহলির সঙ্গে যোগ দিয়ে ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা সূর্যকুমার যাদবকেও ফেরান বাংলাদেশ অধিনায়ক। অবশ্যই এরআগেই ১৬ বলে ৪টি চারে ৩০ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে ফেলেন মারকুটে এই ব্যাটসম্যান। এদিন হার্দিক পান্ডিয়াকে টিকতে দেননি হাসান। ৬ বলে ৫ রান করা হার্দিককে নিজের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত করেন তরুণ এই পেসার।
অন্য প্রান্তে উইকেট পড়তে থাকলেও আপন মনে খেলে যান কোহলি। ১৭তম ওভারে গিয়ে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ৩৬তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন তারকা এই ব্যাটসম্যান। এর আগে ১৬ রান করে মাইলফলক গড়েন তিনি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে এক হাজার রান পূর্ণ হয়েছে কোহলির।
এক হাজার রান পূর্ণ করার পাশাপাশি কোহলি হয়ে গেছেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহও (১০৬৫)। এ পথে তিনি পেছনে ফেলেছেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি মাহেলা জয়াবর্ধনেকে। ১ হাজার ১৬ রান নিয়ে দুই নম্বরে আছেন জয়াবর্ধনে। শেষ পর্যন্ত ৪৪ বলে ৮টি চার ও একটি ছক্কায় ৬৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন ভারতের সাবেক এই অধিনায়ক। শেষ দিকে ৬ বলে ১৩ রান করেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন।
উইকেট না পেলেও চোখ ধাঁধানো বোলিং করেন তাসকিন আহমেদ। ডানহাতি এই পেসার ৪ ওভারে মাত্র ১৪ রান খরচা করেন। ২৪ বলের মধ্যে ১৬টি ডেলিভারিই ডটবল করেন তিনি। হাসান মাহমুদ ৩টি উইকেট নিলেও খরুচে ছিলেন। ৪ ওভারে তার খচরা ৪৭ রান। ২ উইকেট নেওয়া সাকিব ৪ ওভারে ৩৩ রান দেন। মুস্তাফিজ ৪ ওভারে ৩১ রানে উইকেটশূন্য থেকে গেছেন।
শরিফুলের ওপর দিয়ে ঝড় গেছে। অনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ৪ ওভারে ৫৭ রান দেন তিনি, পাননি কোনো উইকেট। তাতে অস্বস্তির এক রেকর্ডে নাম উঠে গেছে তার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক ইনিংসের সবচেয়ে বেশি খরচা করার দিক থেকে শরিফুল এখন দুই নম্বরে। সবচেয়ে বেশি রান দিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪ ওভারে ৬৩ রান দেন তিনি।