রাশিয়া কীভাবে যুদ্ধ দীর্ঘ করার লক্ষ্যে অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করছে
ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের জন্য কয়েকটি অপ্রত্যাশিত দেশ ও উৎসের সাহায্য নিচ্ছে রাশিয়া। খবর ফক্স নিউজের।
বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, রাশিয়ার আক্রমণ স্রেফ কয়েক দিন বা সপ্তাহ স্থায়ী হবে, কারণ রাশিয়া ভেবেছিল সামরিক শক্তি এবং রসদ ও সৈন্যসংখ্যার দিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। তবে নয় মাস পেরোনোর পরও যুদ্ধে টিকে আছে ইউক্রেন। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, রাশিয়া এখন চাইছে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে আসন্ন শীতে ইউক্রেনকে বেকায়দায় ফেলতে। সে লক্ষ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহ অবকাঠামোতেও একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘ করার লক্ষ্যে মস্কো এখন অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের দিকে নজর দিয়েছে।
ডকট্রিন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি কনসালটিংয়ের প্রেসিডেন্ট ও ডিআইএর প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা রেবেকা কফলার ফক্স নিউজ ডিজিটালকে বলেন, 'রাশিয়া স্পষ্টতই নয় মাসব্যাপী যুদ্ধ টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। পুতিন ভেবেছিলেন, এটি এক-দুই সপ্তাহের প্রকল্প হবে। [এবং] রাশিয়ান গোয়েন্দারা পশ্চিমা সমর্থন আদায়ে জেলেনস্কির সামর্থ্য, ইউক্রেনীয়দের লড়াই করার ইচ্ছা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অভূতপূর্ব স্তরের নিরাপত্তা সহায়তা প্রদানের ইচ্ছা এবং এবং রুশ বাহিনীর কৌশলগত সীমাবদ্ধতা সঠিকভাবে অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে।'
বিশেষজ্ঞরা এর আগে ফক্স নিউজ ডিজিটালকে বলেছিলেন কীভাবে 'ব্যাপক' দুর্নীতি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলেছে। তারা অভিযোগ তুলেচিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গত ত্রিশ বছরে অলিগার্করা সেনাবাহিনীতে অর্থ বিনিয়োগ করার বদলে নিজেদের পকেটে পুরেছেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকে ভারী বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব রসদকে শক্তিশালী করেছে ইউক্রেন। এর ফলে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা ভালোই প্রতিরোধ গড়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে। এর ফলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পূর্ব সীমান্তে সৈন্য প্রত্যাহার করেন।
কিন্তু রাশিয়া এখন তার মিত্রদের নিয়ে নিজের জোট গড়ে তুলতে শুরু করেছে। যদিও সেই মিত্রদের কেউ কেউ চুপিসারে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
রেবেকা কফলার বলেন, রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনে ৩-৪ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। বিশেষ করে শীতের আগে বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহ ব্যাহত করার জন্য ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে গত দুই সপ্তাহে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। কফলার দাবি করেন, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত 'নিশ্চিতভাবে'ই কমছে। তিনি বলেন, মস্কোর বর্তমান ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ যুদ্ধপূর্ব স্তরের ৪০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তুলেছে যে, উত্তর কোরিয়া গোপনে রাশিয়াকে আর্টিলারি শেল সরবরাহ করছে। এছাড়া ইরানের বিরুদ্ধেও রাশিয়াকে শাহেদ-১৩৬ 'কামিকাজে' ড্রোন সরবরাহ ও সেগুলোর ব্যবহার শেখানোর জন্য রাশিয়ান সেনাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের অভিযোগ ওঠে। নতুন কয়েকটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ইরান এখন রাশিয়াকে মোহাজের-৬ ও শাহেদ-১২৯ ড্রোনও সরবরাহ করছে।
রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটির মুখপাত্র জন কার্বি এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে বলেছেন, উত্তর কোরিয়া মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মাধ্যমে অস্ত্রের চালানগুলো পাঠিয়ে লুকানোর চেষ্টা করেছে।
কার্বি বলেন, এসব চালান নিয়ে জবাবদিহিতার বিষয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে পরামর্শ করবে ওয়াশিংটন। তবে এসব অস্ত্র যুদ্ধের গতি বা ফলাফল বদলাতে পারবে না বলে মনে করেন কার্বি।
দ্য ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডিফেন্স অভ ডেমোক্রেসিজ (এফডিডি) রিপোর্ট করেছে, ইরানও রাশিয়াকে সহায়তাপ্রদান বাড়াতে পারে। মস্কোকে স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে পারে তেহরান। এর অর্থ একটাই—জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অভ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) বা পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে তেহরান যেটুকু অর্থনৈতিক স্বস্তি লাভ করবে, তা কমে যাবে যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তা ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই ইরানের ওপর থেকে তুলে নেওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো ফের ফিরিয়ে আনার দাবি করছেন।
রাশিয়াকে ইরান যেসব অস্ত্র দেবে সেগুলোর মধ্যে ফতেহ-১১০ ও স্বল্প-পাল্লার জুলফিকার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও থাকবে। ফতেহ-১১০ ১৫০ থেকে ১৮০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারে। আর জুলফিকার খুব সম্ভব ৪৩৫ মাইল পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
ইরান ইতিমধ্যে রাশিয়াকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ড্রোন পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ড্রোনের বেশিরভাগই ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইরানিয়ান এভিয়েশন অ্যান্ড স্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (আইএএসআইএ) পরিচালিত কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হয়।
শুধু অস্ত্র দিয়ে এ যুদ্ধ জেতা যাবে না। তাই পুতিন তার সেনাসংখ্যাও বাড়াতে চান। সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রধান রিচার্ড মুর উভয়েই দাবি করেছেন, যুদ্ধের প্রথম পাঁচ মাসে রাশিয়া প্রায় ১৫ হাজার সৈন্য হারিয়েছে। এই সেনা ঘাটতি পূরণে সক্রিয় হয়েছে রাশিয়া।
ফক্স নিউজ ডিজিটালকে গোল্ডবার্গ বলেছেন, আমরা কয়েক মাস ধরে লক্ষ করছি যে সিরিয়া, লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র থেকে ওয়াগনার গ্রুপকে দিয়ে বিদেশি ভাড়াটে সৈন্য নিয়ে আসছে রাশিয়া।
এর আগে রাশিয়া চেচেন যোদ্ধাদেরও নিয়ে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। গত এপ্রিলে সিরিয়ান ও জর্জিয়ান যোদ্ধাদেরও পুতিন নিয়ে এসেছেন বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
এদিকে গত সপ্তাহে একাধিক আফগান সামরিক ও নিরাপত্তা সূত্র দাবি করেছে যে এলিট ন্যাশনাল আর্মি কমান্ডো কর্পস সৈন্যরা রুশ বাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করেছে। প্রাক্তন কমান্ডোদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে ফরেন পলিসি।
এর আগে ইনসাইডার ও ওয়ারজোনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশিরভাগ পলাতক আফগান সেনা ইরানে অবস্থান করছে। ইরান তাদের আশ্রয় দিলেও, কর্মসংস্থান দিতে পারেনি। ফরেন পলিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সাবেক এই আফগান কমান্ডোদের অনেকেই নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপে পাচ্ছেন ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধে যোগদানের আমন্ত্রণ। এজন্য তাদের আকর্ষণীয় চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ার মার্সেনারি সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপ এই নিয়োগ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের দাবি, রাশিয়ার নিজস্ব সৈন্য কমে আসছে বলে তারা ভাড়াটে সৈন্য আনা বাড়িয়েছে।
তবে অনেকেরই মত, ভাড়াটে সৈন্য আনার পেছনে পুতিনের উদ্দেশ্য, রুশ সৈন্য যেন কম মারা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও চলমান যুদ্ধে পুতিন কিছুতেই পিছু হটবেন না। উল্টো তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে, খুব সম্ভব, বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্য ভাড়া করে আনছেন পুতিন।