ইমরান খানের ওপর আক্রমণ কি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শোডাউনের শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে?
এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী এস্টাবলিশমেন্টের নেতৃত্বদানকারী বিশিষ্ট জেনারেলদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন জোগাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ প্রচারণা শুরু করেন ইমরান খান। বৃহস্পতিবার তাকে হত্যাচেষ্টার নাটকীয় ঘটনাটি প্রভাব ফেলবে দু পক্ষেই। ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এ দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বিষয়টিতেই আলোকপাত করেছে।
পাকিস্তানে আগাম জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে রাজধানী ইসলামাবাদমুখী মিছিলের সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন ৭০ বছর বয়সী ইমরান খান। এই আক্রমণের জন্য ইমরানের উত্তরসূরি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ও দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার তদারকিকারী ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই-এর একজন কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে তার দল
অন্যদিকে, একজন নিহত ও সাতজন আহত হওয়া এ গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে শেহবাজ শরীফ এ ঘটনা তদন্তের নেতৃত্বে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সারা দেশে এবং সামাজিক মাধ্যমে ইমরান খানের প্রতি যে সহানুভূতির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, তা দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর উপর যে আরও চাপ সৃষ্টি করবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক সময়ই সরাসরি পাকিস্তান শাসন করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক অনিত মুখার্জি বলেছেন, "সামনে রক্তাক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।"
দক্ষিণ এশিয়ায় বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা এই অধ্যাপক বলেন, "ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, তারা এস্টাবলিশমেন্টের ওপর এ ক্ষোভ মেটাতে পারেন।"
ইমরান খানের ওপর এ আক্রমণের ফলে দেশটির শীর্ষ জেনারেলদের উপর তার বিরুদ্ধচারণ সামনে আরো তীক্ষ্ণ হবে। গত মাসে গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বিভিন্ন আইনি মামলার মুখোমুখি হওয়া, জাতীয় নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষিত হওয়া, এমনকি জেলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও পাকিস্তানে ইমরান খানের সমর্থক কিন্তু কম নয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তাদের প্রায় সবাইকেই নির্বাসিত কিংবা হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি ইমরান খানকে যেভাবে প্রচারাভিযানের সময় আক্রমণ করা হয়েছে, ঠিক এভাবেই প্রচারাভিযান চালানোর সময় হত্যা করা হয় বেনজীর ভুট্টোকে।
ইমরানের উপর এই আক্রমণ দেশটির সামরিক সংস্থার অবস্থানকেও জটিল করে তুলেছে, যারা ২০১৮ সালে তার ক্ষমতায় উত্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু তাদের এ সমর্থন গত বছরই স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে, ইমরান খানের উপর ভবিষ্যতে কোনো আক্রমণ ঘটলে, বা পরবর্তী নির্বাচনে তাকে অংশগ্রহণ না করতে দিলে স্পটলাইটে থাকবেন এই মেজর জেনারেলরাই।
পাকিস্তানে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত টিসিএ রাঘবন বলেছেন, "পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এমন কোনো পরিস্থিতি চাইবে না যেখানে তাদেরকে বিপুল সংখ্যক লোকের ওপর শক্তির প্রয়োগ ঘটানোর প্রয়োজন পড়ে। সামনে যদি প্রতিবাদ বাড়তে থাকে, তাহলে সেনাবাহিনী হয়তো সরকারকে ইমরান খানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলতে পারে।"
এদিকে, পাকিস্তানের শক্তিশালী ব্যক্তিদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা বর্তমান প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তার ছয় বছরের দায়িত্ব শেষে এই মাসেই অবসর নিতে চলেছেন। এতে করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়টি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জন্য আরো বেশি সংবেদনশীল হতে যাচ্ছে।
বর্তমানে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনার মূলে রয়েছে সামরিক পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণে ইমরান খানের প্রচেষ্টা। গত বছরের শেষদিকে ইমরান জনসমক্ষে দেশটির গুপ্তচর সংস্থার নেতৃত্বদানকারী হিসেবে কামার জাভেদের বিরোধিতা করেন। জাভেদের বদলে ইমরান নিজেরই এক মিত্রকে এই দায়িত্বে বসার জন্য সমর্থন করেন।
ইমরান খানের ওপর এ ঘটনার প্রভাব দেখা যায় তার ছয় মাস পর। এই ঘটনাই সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির বীজ বপন করেছিল বলে ধরে নেওয়া হয়।
ক্ষমতা হারানোর পর শীর্ষ জেনারেলদেরকে পরোক্ষভাবে 'জন্তু' ও 'বিশ্বাসঘাতক' বলে অভিহিত করায় গত সপ্তাহে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে সামরিক কর্মকর্তারা ইমরান খানের সমালোচনা করেন।
পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আহমেদ আঞ্জুম বলেন, "আমরা তাকে [ইমরান খান] বলেছিলাম, সেনাবাহিনী কোনো অসাংবিধানিক ভূমিকা পালন করবে না কারণ তারা অরাজনৈতিক থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা বলেছিলাম আপনি যদি ক্ষমতায় ফিরতে চান তবে রাজনৈতিকভাবে পদক্ষেপ নিন।"
এতকিছুর পরে আবারও ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ কোনো প্রমাণাদি ছাড়াই আরেক আইএসআই নেতার বিরুদ্ধচারণ করছে। ইমরানকে আক্রমণের পেছনে মেজর-জেনারেল ফয়সাল নাসিরের হাত আছে বলে দাবি করছে তারা। অন্যদিকে অভিযুক্ত শ্যুটার বলছেন, ইমরান খানকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনা তিনি একাই করেন।
হামলায় একজন অফিসার জড়িত ছিল বলে ইমরান খানের অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে বলা হলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্বে দেওয়া একটি বিবৃতির পুনরাবৃত্তি করে। সেখানে তারা এ আক্রমণকে 'অত্যন্ত নিন্দনীয়' হিসেবে অভিহিত করে এ 'দুর্ভাগ্যজনক' ঘটনায় আহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্যদের দ্রুত সুস্থতার আশাব্যক্ত করেছেন।
এদিকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাথে আরও রক্তপাতের ঝুঁকিতে হুমকির মুখে পড়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। কিছুদিন আগেই ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া পাকিস্তান এখনও ঋণদাতা দেশগুলোর কাছ থেকে তহবিল চেয়ে যাচ্ছে।
তবে, নিজের ক্ষমতাচ্যুতির জন্য মার্কিন হস্তক্ষেপের বিষয়ে ইমরান খান বরাবরই তার অবস্থান জোরালো রেখেছেন। যদিও বাইডেন প্রশাসন এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
লাহোর-ভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক এজাজ হুসেন বলেন, "ইমরান খানের এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী এবং আমেরিকা-বিরোধী অবস্থানের কারণেই পাকিস্তানের জনতাকে তার পক্ষে রয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট আসন জিততে পারেন তিনি।"
আবার ইমরান খান ক্ষমতায় ফিরলে নতুন সামরিক প্রধান নিয়োগের চেষ্টা করতে পারেন, যা আসলে একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনের পর পদচ্যুত করা হয়েছিল সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফকে। পদচ্যুত হওয়ায় তৎকালীন নেতা নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান পরিচালনা করেছিলেন তিনি।
যাহোক, ইমরান খান ও তার পিটিআই সমর্থকরা শেহবাজ শরীফ এবং সামরিক বাহিনীকে তাদের দাবি পূরণে বাধ্য করতে যথেষ্ট জনসমর্থন জোগাড় করতে পারে কিনা তার প্রমাণ মিলবে সামনের কয়েকদিনেই।