সাজেকে নিয়ন্ত্রণে আসছে না হাম
রাঙামাটির পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ৭ নম্বর পাড়া থেকে সাজেক সড়কের পাশে পাঁচ সন্তানকে ডাক্তার দেখাতে আনেন পতিমালা ত্রিপুরা (৪০)। সঙ্গে আরও তিন শিশু। বড়টির বয়স পাঁচ বছর। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিশু হামে আক্রান্ত।
পতিমালা বলেন, ওদের প্রথমে জ্বর হয়। এরপর পুরো শরীরে গুটি দেখা দেয়। চোখ মুখ ফুলে লাল হয়, চোখের কোনায় ময়লা জমে। শাসকষ্ট বাড়ে। জ্বর থাকে। কোনো কিছু খেতে চায় না।
ডাক্তাররা একে হাম বলছেন। চাকমারা বলে লুদি। মারমারা বলে ওয়োসাহ্। ত্রিপুরারা বলে লুতিসাহ্।
অসুস্থ শিশুদের গরম পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেন না পতিমালা। ওষুধ হিসেবে পুজি পাতার (সুগন্ধি পাতা যা জুমে চাষ হয়) পানি খেতে দেন। আর বনের লতাপাতা সিদ্ধ করা পানি দিয়ে গোসল করান।
একই গ্রামের ধনেন্দ্রলাল ত্রিপুরার (৪০) দুই শিশুও হামে আক্রান্ত। তিনিও একইভাবে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তবে কুসংস্কারে বিশ্বাসী হওয়ায় তার শিশুদের শুকরের বিষ্ঠা মিশ্রিত পানিও খেতে দিয়েছেন বলে জানান ধনেন্দ্রলাল।
শিবপাড়া গ্রামের গোপতি ত্রিপুরা (৪৫) বলেন, অসুস্থ শিশুকে তেল, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়ানো হলে গুটি আরও বাড়ে। এ ভয়ে শুধু গরম পানি পান করতে দিচ্ছেন। এটা গ্রামের সবাই করে। টিকা নিলে শিশুদের জ্বর হয়। কান্না করে। তাছাড়া এ টিকা নিলেও কি উপকার হয়, তা আমার জানা নেই!
এ কথাগুলো শুধু পতিমালা, ধনেন্দ্রলাল, গোপতি ত্রিপুরার নয়। কথাগুলো সাজেকের দুর্গম শিবছড়া, ৭ নম্বর, শিয়ালদহ, অরুণ পাড়া, তুইচুইসহ আরও কয়েক গ্রামের মানুষের।
সেসব গ্রামে যাতায়াতের উপায় মূলত পায়ে হাঁটা। কোথাও চলে নৌকা। মাচালং বাজার থেকে এসব গ্রামের একেকটির দূরত্ব কোথাও ২০, কোথাও ৭০ কিলোমিটার। মাচালং বাজার থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগে এক থেকে দুই দিন।
স্থানীয় সরকারি ও এনজিও স্বাস্থ্য কর্মীদের তথ্যমতে, এসব গ্রামে বর্তমানে দুই শতাধিক শিশু হামে আক্রান্ত। এ রোগে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত মারা গেছে ৯ জন।
সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে দেখা দেওয়া এ হাম নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে একের পর এক গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।
চলমান মেডিকেল সেবা পর্যাপ্ত নয়
জেলা স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে সাজেকের হাম নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে একাধিক মেডিকেল টিম। তবে সরেজমিনে এর সত্যতা মেলেনি। স্বাস্থ্য কর্মীরা পালাবদল করে এলাকায় গিয়ে একটি দলে কাজ করছেন। এ দলে কাগজে কলমে এমবিবিএস ডাক্তার রাখা হলেও প্যারামেডিক বা স্বাস্থ্য সহকারীকে সেই ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
গত ৩০ মার্চ বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডা. বিষ্ণু পদ দেবনাথের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল দল ৭ নম্বর পাড়ায় যায়। সেখানে মোট ৩১ জন রোগীর মধ্যে ১৮জন শিশু। এরমধ্যে চার শিশুকে হাম বলে শনাক্ত করেন বিষ্ণু পদ। এ চারজনকে হামের ওষুধ দিলেও বাকিদের জ্বরের ওষুধ দেন তিনি।
সেদিনই রোগী দেখে ৭ নম্বর পাড়া ত্যাগ করে সরাসরি বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফিরে যায় মেডিকেল দল। কিন্তু সেই রাতে ৭ নম্বর পাড়ায় আরও দুজনের শরীরে গুটি ভেসে ওঠে।
ডা. বিষ্ণু পদ দেবনাথ বলেন, এখানের চিত্রটা ভিন্ন। অসুস্থ রোগীকে ভালো ও পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়ার বিপরীতে খাবার দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখানে কুসংস্কারে ভরপুর। অবিভাবকেরা সচেতন নন। তাই এখানে দীর্ঘ মেয়াদী কাজ করতে হবে।
সচেতনতা আর পরিচ্ছন্নতায় পিছিয়ে ত্রিপুরারা
সাজেকে চাকমা-ত্রিপুরা পাশাপাশি গ্রামে বসবাস করে। চাকমাদের তুলনায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর ও আঙিনা অপরিচ্ছন্ন দেখা গেছে। এরা যেমন অপরিচ্ছন্ন, তেমনি অসচেতনও।
৭ নম্বর ত্রিপুরা পাড়ার পাশে ৯ নম্বর চাকমা পাড়া। ৯ নম্বরে একজনও হামে আক্রান্ত না হলেও ৭ নম্বরে আক্রান্ত ১২ জন।
৯ নম্বর গ্রামের শান্তি চাকমা (৫৫) বলেন, আমাদের গ্রামে হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩০ বছর আগে একজন মারা গেছে। টিকা কর্মীরা সড়কের পাশে নির্দিষ্ট দোকানে বা স্কুলে বসে শিশুদের টিকা দেন। এ সময় চাকমা শিশুদের টিকা নিতে দেখা গেলেও ত্রিপুরারা আসে না।
স্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যাপ্ত নয়
১৭৭১.৫৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সাজেক ইউনিয়নে জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। রয়েছে মাত্র একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। একটি এনজিও কাজ করলেও প্রকল্প শেষ হওয়ায় চলতি মাসে বন্ধ হওয়ার কথা সেটির কার্যক্রম। কমিউনিটি ক্লিনিকে কোনো ডাক্তার নেই। ক্লিনিকে একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন পিয়ন রয়েছেন।
গুজব আর কুসংস্কারে বিশ্বাস
সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা বলেন, ডাক্তারি চিকিৎসার পরও নাকি আট শিশু মারা গেছে- এমন গুজব ছড়ানো হয়। ফলে অনেকে চিকিৎসা নিতে আসছে না। চিকিৎসা দিতে জোর করতে হচ্ছে আমাদের।
কুসংস্কারের কারণে হাম রোগ থেকে বাঁচতে নানা পূঁজা করে যাচ্ছেন তারা। গুজব রটানোর কারণে অবিভাবকেরা তাদের সন্তানদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে পর্যন্ত তুলতে দিচ্ছেন না।
টিকা পায় না সাজেকের শিশুরা
সরকারি বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচির আওতায় টিকা পায় না সাজেকের শিশুরা। প্রাদুর্ভাব প্রবণ এলাকায় রয়েছে টিকা নেওয়ার ভীতি। এ ছাড়া এলাকায় যখন টিকা পৌঁছায়, তখন টিকা বহনকরা আইসবক্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। আইসবক্সের মেয়াদ থাকে ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু সাজেকে এমন এলাকা রয়েছে, যেখানে ৪৮ ঘণ্টায়ও টিকা পৌঁছানো সম্ভব নয়।
সাজেকের ৯ নম্বর পাড়া গ্রামের গ্রামপ্রধান চিরঞ্জীব ত্রিপুরা (৫০) বলেন, শিশুরা টিকা পায় না। টিকা কার্ড না থাকার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করে দিচ্ছে না।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সবুজ চক্রবর্তী বলেন, যাদের টিকা কার্ড নেই, তাদের জন্ম নিবন্ধন করছি না। আমরা শিশুদের টিকা নিতে অবিভাবকদের চাপ দিচ্ছি।
একাধিক ক্লিনিক দরকার
সাজেকের অর্ধেক এলাকা জুড়ে রয়েছে সংরক্ষিত বন। এর মাঝে রয়েছে বিশাল জনবসতি। বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যায় কাচালং নদীর এপাড় ওপাড়ে রয়েছে চেল্লাতলি, বেতবুনিয়া, উজানছড়ি, লাম্বাবাগ, হজতলি, শিলছড়ি, ভুয়াছড়ি গ্রাম। এছাড়া শিয়ালদহ, তুইচুই মৌজায় আলাদা ক্লিনিক দরকার।
চিকিৎসকদের পরামর্শ
সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শহীদ তালুকদার বলেন, হাম প্রাদুর্ভাব এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেখানকার লোকজনকে সচেতন করা জরুরি। এজন্য ত্রিপুরা কমিউনিটিও উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের ধর্মীয় পুরোহিতরাও এ কাজ করতে পারেন। না হলে এ অপচিকিৎসার প্রতি ঝুঁকে থাকবেন তারা। ডাক্তাররা ওষুধ দিলেও তারা যদি না খান, তাহলে রোগ ভালো হবে না- সেটা বোঝাতে হবে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক কর্মকর্তা ডা. নুয়েন খীসা বলেন, শুধু সাজেক নয়, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে এ সমস্যা। পাহাড়ের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত জনবল নিয়োগ দেওয়া জরুরি। সাজেক ইউনিয়নকে সমতলের কোনো ইউনিয়ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এ ইউনিয়ন দেশের কোনো কোনো উপজেলার চেয়েও বড়। সেখানে মানুষকে হাসপাতালমুখী করতে সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ক্লিনিকের নামে জমি রেজিস্ট্রেশন করতে বন বিভাগের আইন শিথিল করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বন বিভাগের জায়গায় কোনো কিছু করা যাবে না- এ নীতিতে অটল থাকলে ভবিষ্যতে এ চিত্র আরও ভয়াবহ হবে।
বর্তমান সিভিল সার্জন বলেন...
জেলা সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা বলেন, সাজেকে হাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। একটি গ্রামের পর আরেকটিতে দেখা দিচ্ছে। এ কার্যক্রম দুয়েকদিনে শেষ হবে না। আগামী ৯ মাস নিয়মিত করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১১ হাজার শিশুকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।
এজন্য আরও জনবল প্রয়োজন। সাজেকে টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে হলে সে এলাকায় একাধিক পয়েন্ট সোলারে চলে এমন ফ্রিজ রেখে টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, সাজেক বিশাল কর্ম এলাকা। বর্তমানে সেখানে যে জনবল আছে, তা দিয়ে এত বড় প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখানে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে আমাদের। সেখানে সর্বনিম্ন ৫টি ক্লিনিক দরকার। প্রতিটি ক্লিনিকে পাঁচজন করে স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ দেওয়া দরকার। পাশাপাশি এসব স্বাস্থ্য কর্মীদের সহায়তা করতে আইসবক্স বহনের জন্য প্রত্যক স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য একজন করে লোক দরকার। এদের জন্য আলাদা বরাদ্দ প্রয়োজন।