তেজগাঁও বিজনেস হাব: পরিবহন কেন্দ্র থেকে হাঁটার দূরত্বের মধ্যেই সবকিছু
তিন বছর পর আবারো তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনকে কেন্দ্র করে বিজনেস হাব (ব্যবসায়িক কেন্দ্র) গড়ে তোলোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
রেলওয়ে স্টেশন এবং এর আশেপাশে রেলওয়ের প্রায় ৪০ একর জমিতে উন্নত দেশের আদলে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে হবে এই বিজনেস হাব। তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় এটি নির্মিত হবে 'ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট' (টিওডি) ভিত্তিতে। টিওডি হলো একটি শহুরে উন্নয়ন ধরণা। এতে আবাসিক এলাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষের অবসর কাটানোর স্থান- সবকিছুই থাকে গণপরিবহন বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পয়েন্ট থেকে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে।
নিচে রেল চলাচলের ব্যবস্থা ঠিক রেখে রেলট্র্যাকের ওপরে নির্মাণ করা হবে বহুতল বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স- যেখানে থাকবে বাণিজ্যিক অফিস স্পেস, হোটেল এবং কমিউনিটি হল। বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পেরসম্ভাব্যতা সমীক্ষায় যুক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে রেলওয়ে সূত্রে।
রেলওয়ের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এই প্রকল্পে মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮.৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আনুমানিক পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ০.২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, "গতমাসে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে রেলওয়ের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিশ্বব্যাংক রেলওয়ের কাছে ৫টি প্রকল্প প্রস্তাব চেয়েছে। আগে এসব প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করবে বিশ্বব্যাংক; পরে অর্থায়নের বিষয়ে সিন্ধান্ত নেবে।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ রেলওয়ের তেজগাঁও এলাকায় বিজনেস হাব নির্মাণের প্রকল্পটি রেলওয়ের পক্ষে থেকে তালিকার প্রথমে রাখা হয়েছে।"
রেলওয়ে মন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, "রেলওয়ের মূল কার্ক্রমের (যাত্রী ও পণ্য পরিবহন) পাশাপাশি নন-কোর (অপ্রধান) উৎস থেকে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।"
অনেক দেশেই এটি করা হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, "আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের অব্যবহৃত ভূমি ব্যবহার, গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনকেন্দ্রীক বিনিয়োগ এবং রেলের আয় বৃদ্ধি করা; যেখানে মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব, মার্কেট, হোটেলসহ বিভিন্ন স্থাপনা থাকবে।"
এই হিসেবে তেজগাঁও একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন এবং এর আশেপাশের জায়গা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। মূলত এই পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে রেলওয়ে।
কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনকে মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তেজগাঁও স্টেশনেরও অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।
রেলওয়ে ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানায়, পিপিপি প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়নের জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও জমি বেখল থাকায় পরে তা পিছিয়ে যায় ।
তেজগাঁওয়ের স্টেশনের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ট্রাক স্ট্যান্ড। ফলে দখলমুক্ত করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল । ভূমি দখল জটিলতায় বিনিয়োগকারীরা এ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না বিবেচনায়, প্রকল্প প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদের সভায় ওঠানো হয়নি বলে জানা গেছে রেলওয়ে ও পিপিপি কর্তৃপক্ষ সূত্রে।
রেলওয়ের বিজনেস হাব পরিকল্পনা অনুযায়ী, আকাশপথের উন্নয়নের জন্য কলামসহ রেলওয়ের ওপরে একটি ডেক তৈরি করা হবে এবং রেলপথ এড়াতে গ্রাউন্ড লেভেলের একটি গ্রিডে তা স্থাপন করা হবে। উপরের ডেকটি নির্মাণের পরে রেল পরিষেবাগুলো কোনো বাধা ছাড়াই পরিচালিত হবে।
পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির মহাপরিচালক মোঃ আবুল বাশারবলেন, "আমাদের স্ক্রিনিং এসেসমেন্ট রিপোর্টে প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু পরে রেলওয়ের আগ্রহ কমে যায়। রেলওয়ে আগ্রহী হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।"
পিপিপি অফিসের স্ক্রিনিং অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল ঢাকার তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবহৃত জমির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করে রেলওয়ে খাতে আর্থিক সুবিধা ও অবদান যোগ করা।
যদিও বাংলাদেশে টিওডি ভিত্তিক প্রথম পিপিপি প্রকল্প এটি, বিশ্বজুড়ে এ ধরনের প্রকল্প খুবই জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্স, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অন্যান্য অনেক দেশ সরকারি সম্পদের সর্বাধিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই মডেল ব্যবহার করেছে।
জাপানের টোকিও এবং তোমায়া স্টেশন, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর স্টেশন, পেরুর লিমা স্টেশন এবং অন্যান্য আরও অনেক স্টেশন সফলভাবে পিপিপি স্কিমের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, তেজগাঁও স্টেশন কেন্দ্রে রেলওয়ের প্রায় ৮০ ভাগ জমি অবৈধভাবে দখল হয়ে আছে। সেখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড। এছাড়া, তেজগাঁও স্টেশনের পাশে রেলওয়ে কলোনির বেশিরভাগ জায়গাও বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে রয়েছে। তবে রেলওয়ের এই প্রকল্প চূড়ান্ত হলে ভূমি দখলমুক্ত করা হবে বলে জানান চিফ এস্টেট অফিসার সুজন চৌধুরী।
এদিকে, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের জন্য বিকল্প জায়গা না দিলে তেজগাঁয়ের জায়গা ছাড়া হবে না বলে টিবিএসকে জানান ট্রাক কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার মালিক সমিতির সভাপতি তালুকদার মনির।
তিনি বলেন, তেজগাঁয়ের এই জায়গা ব্যবহারের জন্য রেলওয়ের সাথে তাদের চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সরকার বিকল্প জায়গা না দেওয়া পর্যন্ত, তেজগাঁয়ের ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা যাবে না।
ঢাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের এস্টেট অফিসার মোঃ সফিউল্লা জানান, তেজগাঁয়ে রেলওয়ের যে জায়গায় ট্রাক স্ট্যান্ড হয়েছে, তার জন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তি নেই।
"রেলওয়ের এখন প্রয়োজন হচ্ছে না বলে তা উদ্ধার করা হচ্ছে না। রেলের প্রয়োজনে যেকোনো সময় তা উদ্ধার করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না," যোগ করেন তিনি।