পানি সংকটের কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকেরা ধানের পরিবর্তে ঝুঁকছেন সবজি চাষে
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পরছে পুরো বিশ্বজুড়েই। তবে এ পরিবর্তনের ফলে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের ভুক্তভোগী যার মধ্যে কৃষি অন্যতম। দুই দশক আগেও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষকেরা বিপুল পরিমাণে ধান চাষ করতেন। কিন্তু বর্তমানে একদিকে যেমন জলবায়ু বদলেছে, ঠিক তেমনি কমেছে পর্যাপ্ত পানি প্রাপ্তির সুযোগ। আর তাই বর্তমানে পানি সংকটের কারণে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকেরা ধানের পরিবর্তে ঝুঁকছেন সবজি চাষে।
ধানচাষের জন্য প্রতিনিয়ত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির দরকার হয়। কিন্তু সবজি চাষের ক্ষেত্রে ধানের তুলনায় কম পানির দরকার হয়। আর এ সুযোগটিই নিয়েছেন পানির অভাবে ফসল ফলাতে না পারা কৃষকেরা। শফিকুল ইসলাম বাবু নামের এক কৃষক এবিসি নিউজকে বলছেন নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের গল্প। কৃষক শফিকুল বলেন, "আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ধানের পরিবর্তে আমি ঠিক কী চাষ করবো। কেননা আমার পূর্বপুরুষেরা জমিতে ধানই চাষ করে গেছেন। তাই পানির অভাবে ধান চাষ করতে না পেরে নিজের জমানো টাকা খরচ করে সংসার চালাচ্ছিলাম।"
পরবর্তীতে নিজের ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে ২০ হেক্টর জমিতে বাঁধাকপি চাষের সিদ্ধান্ত নেন শফিকুল। জীবন সংগ্রামে লড়াই করতে থাকা এ কৃষক বলেন, "সবজি চাষের মাধ্যমে আমি আবার আশার আলো দেখতে পাই। আগে ধান চাষ করে মাত্র বছরে মাত্র ৮০ হাজার টাকা আয় করতাম। কিন্তু বর্তমানে সবজি চাষ করে বছরে প্রায় ২ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা আয় করছি।"
আট বছর আগেও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ধান চাষের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলে বর্তমানে বাঁধাকপি, গাজর ও লাউয়ের মত সবজি উৎপাদন করা হয়। কেননা সবজিগুলো রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে ভালো লাভ করা যায়।
রাজশাহী জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রধান শামসুল ওয়াদুদ জানান, পর্যাপ্ত পানির অভাবে কৃষকেরা আগে বছরে দুইবার ধান উৎপাদন করতে হিমশিম খেত। কিন্তু বর্তমানে খুব সহজেই কৃষকেরা একই জমিতে বছরের তিন থেকে চারবার সবজি উৎপাদন করতে পারেন। ফলে সবজি চাষে লাভবান হয়ে বর্তমানে রাজশাহীতেই প্রায় ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয় যা দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি।
শুধু দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নয়, বরং সারাদেশেই সবজি চাষের দিকে নজর দিয়েছেন বাংলাদেশ দরকার। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই দেশের সকল পরিত্যাক্ত ও বেলে জমিতে সবজি উৎপাদন করতে কৃষকদের উৎসাহিত করছে। কেননা অনুর্বর জমিতে অন্য ফসল ফলাতে অসুবিধা হলেও খুব সহজেই সবজি উৎপাদন করা যায়।
অন্যদিকে দেশের সিলেট অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হলেও সম্প্রতি রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে আশংকাজনক হারে বৃষ্টিপাত কমেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান জানান, দেশের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অর্ধেকেরও কম। অন্যদিকে বৃষ্টির পানির বিকল্প হিসেবে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলনের পথও প্রায় বন্ধ হচ্ছে। কেননা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রিপোর্ট মতে, দেশের বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলের পানির গভীরতা প্রতিবছর প্রায় ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, টমেটো, মুলা ও গাজরের মত সবজির তুলনায় ধান চাষ করতে প্রায় দশ গুণ বেশি পানির দরকার হয়। এমতবস্থায় নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে ধান চাষিরা পরিণত হচ্ছেন সবজি চাষিতে। তবে ধান উৎপাদনের পর তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু সবজি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে তা দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। তাই সবজি চাষে আগ্রহ বাড়াতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে জমি থেকে তোলা সবজি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার তৈরির প্রতি জোর দিয়েছেন প্রান্তিক সবজি চাষিরা।
সূত্র: এবিসিডটনেট