শ্রীলঙ্কা সংকট: মা-বাবারা বাধ্য হচ্ছেন কোন সন্তান স্কুলে যাবে বাছাই করতে
সদ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করে আসা শ্রীলঙ্কা এখন নানা সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত। দেশটিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত প্রতিটি পরিবার নিজেদের তিন বেলার খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে। মৌলিক অধিকার পূরণের জন্যও সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের। দেশটিতে একই ঘটনা ঘটেছে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রেও। শ্রীলঙ্কার যেসব পরিবারে একাধিক সন্তান রয়েছে, সেসব পরিবারে সব সন্তানদের স্কুলে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তারা কোন সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন আর কোন সন্তানকে কাজে নিয়োজিত করবেন।
ছয় মাস আগে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যখন ভেঙে পড়ে তখন অন্যসব পরিবারের মতোই চরম দুর্দশায় পরে ১০ বছরের শিশু মালকির পরিবার। পরিবারে মালকির দুই ভাই এবং দুই বোন রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমানে মালকি ও তার ভাইবোনেরা সবাই স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, বরং পরিবারের পাঁচ সন্তানের মাঝে শুধু মালকিই স্কুলে যেতে পারছে।
বর্তমান পরিস্থিতে পরিবারের আর্থিক সংকটের কথা চিন্তা করে মালকির বাবা-মাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় বর্তমানে খাবার দাম প্রায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দেশটির অন্যসব দরিদ্র পরিবারের মত মালকির পরিবারও অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মালকির অন্য ভাই-বোনেরা স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে আতশবাজি বিক্রি করে পরিবারকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় শিশুদের বিনামূল্যে স্কুলে পড়ানো যায়। কিন্তু বর্তমানে স্কুলে শিশুদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না। তাই শিশুদের স্কুলে পাঠালে একটি পরিবারকে স্কুল চলাকালীন ঐ শিশুর খাবার, যাতায়াত ও ইউনিফর্মসহ নানা আনুষঙ্গিক খরচ করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই ব্যায়ভার বহন করা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব।
অশ্রুসিক্ত নয়নে মালকির মা প্রিয়ান্তিকা সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানান, তার সব ছেলে-মেয়েই আগে স্কুলে যেত। কিন্তু এখন তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ প্রতিদিন সবাইকে স্কুলে পাঠাতে পরিবারটিকে ন্যূনতম প্রায় ৪০০ রুপি খরচ করতে হবে যা পরিবারটির কাছে নেই।
প্রিয়ান্তিকা আরও বলেন, "মালকি এখনো স্কুলে যেতে পারছে কারণ তার স্কুল ইউনিফর্মগুলো নষ্ট হয়ে যায়নি। মালকির স্কুল ইউনিফর্মগুলো নষ্ট হয়ে গেলে হয়তো তারও স্কুল যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পরবে।" মালকিকে স্কুলে যেতে দেখে তার ছোট বোন দুলাঞ্জলিও স্কুলে যাওয়ার বায়না করে, কান্নাকাটি করে। তখন মা প্রিয়ান্তিকা মেয়ের কান্না থামিয়ে খুব শীঘ্রই স্কুলে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেন।
শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, বরং এই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের অবস্থাও নাজেহাল। কলম্বোর কোটাহেনা সেন্ট্রাল সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ প্রকর্মা বীরাসিংহে বলেন, "আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৪০ ভাগ কমে গেছে। সকালে অ্যাসেম্বলির সময় অনেক শিক্ষার্থীই ক্ষুধার জ্বালায় অজ্ঞান হয়ে মাঠে পড়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলগুলোতে চাল বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হলেও আমরা এখনো তা পাইনি।"
অন্যদিকে সিলন টিচার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্টালিন জানান, ঠিক কত পরিবার যে টাকার অভাবে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে সেই হিসেব সরকারের কাছেও নেই। শিক্ষকেরা প্রায়ই দেখেন যে, শিক্ষার্থীদের খালি টিফিন বক্স নিয়ে স্কুলে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, "অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সরকার শিক্ষা খাতে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিক নয়। কিন্তু ইউনিসেফ থেকে শুরু করে অন্য বেসরকারি সংস্থাগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।"
ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় চলমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে পরিবারগুলোর কাছে চাল কেনারই টাকা নেই। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়বে।
ইউনিসেফ ছাড়াও আরও অনেক দাতা সংস্থা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে। কিন্তু এদের মাধ্যমে হয়তো অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখা চালাতে পারবে। কিন্তু মালকির ভাই-বোনদের মতো একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
সূত্র: বিবিসি