চ্যাটজিপিটি অনুমতি ছাড়াই আমাদের তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেসব ব্যবহার করে এখন কোটি টাকা কামিয়ে নেবে!
গোটা বিশ্ব এখন উত্তাল চ্যাটজিপিটি। বাজারে আসার দুই মাসের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী এই টুল ব্যবহার করছেন। প্রযুক্তি জগতের ইতিহাসে আর কোনো অ্যাপ এত অল্প সময়ে এত বেশিসংখ্যক ব্যবহারকারী পায়নি। ব্যবহারকারীরা চ্যাটজিপিটির অত্যাধুনিক সক্ষমতা নিয়ে উচ্ছ্বসিত—আবার বিভিন্ন খাতে এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে চিন্তিতও বটে।
তবে দ্য কনভারসেশন-এর প্রতিবেদনে চ্যাটজিপিটির আরেকটি ঝুঁকি উঠে এসেছে, যা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। সেটি হচ্ছে—গোপনীয়তার (প্রাইভেসি) ঝুঁকি।
চ্যাটজিপিটির পিছু পিছু গুগলও তাদের চ্যাটবট টুল বার্ড বাজারে ছেড়েছে। সন্দেহ নেই, আরও অনেক প্রযুক্তি কোম্পানি এরকম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) টুল বাজারে আনার ইঁদুরদৌড়ে নাম লেখাবে।
তবে সমস্যা হচ্ছে এই চ্যাটবট টুলগুলো তৈরির জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য।
৩০০ বিলিয়ন শব্দ
চ্যাটজিপিটি তৈরি করা হয়েছে বড় একটি ভাষা-মডেলের ওপর ভিত্তি করে। এ মডেল ভালোভাবে কাজ করতে হলে বিস্তর তথ্য প্রয়োজন।
যত বেশি তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, চ্যাটজিপিটি তত ভালোভাবে প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে পারবে। নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারবে ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে। এবং আরও বেশি বেশি ভালো লেখা লিখতে পারবে।
চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে ওপেনএআই। প্রতিষ্ঠানটি এই টুলকে ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা প্রায় ৩০০ বিলিয়ন (৩০ হাজার কোটি) শব্দ 'খাইয়েছে'। অর্থাৎ চ্যাটজিপিটির শব্দভান্ডারে ৩০ হাজার কোটি শব্দ আছে। আর এই সব শব্দই এসেছে ইন্টারনেট থেকে।
আপনি যদি কখনও কোনো ব্লগ পোস্ট, কোনো পণ্যের রিভিউ কিংবা কোনো অনলাইন নিবন্ধের ওপর মন্তব্য করে থাকেন, তাহলে ভালো সম্ভাবনা আছে যে চ্যাটজিপিটি এসব পড়েছে।
সমস্যা কোথায়?
চ্যাটজিপিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াটিতে বেশ কিছু কারণে ঘাপলা আছে।
প্রথমত, ওপেনএআই কারও কাছ থেকেই আমাদের তথ্য ব্যবহার করার অনুমতি নেয়নি। এটি গোপনীয়তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিশেষ করে তথ্য যখন স্পর্শকাতর হয় এবং তা আমাদের ও আমাদের পরিবারের সদস্যদের অবস্থান অথবা আমাদের অবস্থান অবস্থান শনাক্ত করা হয়, তখন তো এ কাজ আরও সুস্পষ্টভাবে গোপনীয়তার লঙ্ঘন।
এমনকি তথ্য যদি পাবলিকও থাকে, তখনও এসবের ব্যবহার 'টেক্সচুয়াল নৈতিকতা' লঙ্ঘন করতে পারে। গোপনীয়তার আইনি আলোচনায় এটি একটি মৌলিক নীতি। এ নীতির আওতায় একটি তথ্য প্রথম যে জায়গায় বা প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার বাইরে প্রকাশ করা যায় না।
এছাড়াও আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করছে কি না, তা যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি ওপেনএআই। আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য মুছে দেওয়ার জন্য ওপেনএআইকে অনুরোধ করার ব্যবস্থাও নেই। ইউরোপিয়ান জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন অনুসারে, এই অধিকার দেওয়া বাধ্যতামূলক। যদিও চ্যাটজিপিটি ইউরোপিয়ান জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন-এর নিয়ম মানতে বাধ্য কি না, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।
যেখানে তথ্য ভুল বা বিভ্রান্তিকর—চ্যাটজিপিটিতে যা নিয়মিত হয় বলে ধারণা করা হয়—এই 'ভুলে যাওয়ার অধিকার' বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ।
এছাড়া যেসব তথ্য ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ওসব তথ্য কারও মালিকানা বা কপিরাইটের আওতায় থাকতে পারে। যেমন চ্যাটজিপিটিকে আদেশ দিলে এটি জোসেফ হেলারের 'ক্যাচ-২২' বইয়ের কয়েকটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিতে পারে—কিন্তু এ বইটির লেখা এখনও কপিরাইটের আওতায় আছে।
তাছাড়া ওপেনএআই ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা এসব তথ্যের জন্য অর্থ প্রদান করেনি। যেসব ব্যক্তি, ওয়েবসাইটের মালিক ও কোম্পানি এসব তথ্য তৈরি করেছে, তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। বিশেষভাবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক মূল্য ২৯ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। ২০২১ সালে ওপেনএআইয়ের মূল্য ছিল এর অর্ধেকেরও কম।
ওপেনএআই অতিসম্প্রতি চ্যাটজিপিটি প্লাস আনার ঘোষণা দিয়েছে। চ্যাটজিপিটি প্লাস ব্যবহার করতে হবে অর্থের বিনিময়ে সাবস্ক্রিপশন কিনে।
ওপেনএআইয়ের এই আয়ের একটি পয়সাও তথ্য—আমাদের তথ্য—ছাড়া সম্ভব হতো না। আর এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আমাদের অনুমতি না নিয়েই।
ধোঁয়াশাপূর্ণ গোপনীয়তার নীতি
ব্যবহারকারীরা ইউজার প্রম্পট আকারে চ্যাটজিপিটিকে যেসব তথ্য দেয়, তা নিয়েও ঝুঁকি আছে। আমরা যখন টুলটিকে প্রশ্নের উত্তর দিতে বা কোনো কাজ করতে বলি, তখন অসাবধানতাবশত সংবেদনশীল তথ্য দিয়ে ফেলতে পারি এবং এ তথ্য পাবলিক ডোমেইনেই রেখে দিতে পারি।
যেমন, একজন আইনজীবী টুলটিকে একটি খসড়া বিবাহবিচ্ছেদ চুক্তি পর্যালোচনা করতে অনুরোধ করতে পারে, অথবা একজন প্রোগ্রামার চ্যাটজিপিটিকে কোডের একটি অংশ পরীক্ষা করতে বলতে পারে। চুক্তি ও কোড এরপর চ্যাটজিপিটির ডেটাবেজের অংশ হয়ে যাবে। এর অর্থ হলো, এসব তথ্য ব্যবহার করে টুলটিকে আরও প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে।
এর বাইরেও অন্যান্য ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহের বিস্তর সুযোগ আছে ওপেনএআইয়ের। নিজেদের গোপনীয়তার নীতি অনুসারে, কোম্পানিটি ব্যবহারকারীদের আইপি অ্যাড্রেস, ব্রাউজারের ধরন ও সেটিংস এবং সাইটের সাথে ব্যবহারকারীদের মিথস্ক্রিয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। ব্যবহারকারীরা যে ধরনের বিষয়বস্তু ব্রাউজ করেন, তাদের ব্যবহার করা ফিচার, তারা অনলাইনে কী করেন না করেন, এসব তথ্যও সংগ্রহ করে ওপেনএআই।
ওপেনএআই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ব্যবহারকারীদের ব্রাউজিং কার্যকলাপের তথ্যও সংগ্রহ করে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ওপেনএআই বলেছে, তারা তাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য অনির্দিষ্ট তৃতীয় পক্ষকে জানাতে পারে, তা-ও ব্যবহারকারীদের না জানিয়েই।
সতর্কতা প্রয়োজন
কিছু বিশেষজ্ঞের বিশ্বাস, চ্যাটজিপিটি আমাদের কাজ করার, শেখার, লেখার। এমনকি চিন্তা করার পদ্ধতিতেও বিপ্লব আনতে পারে।
চ্যাটজিপিটির সম্ভাব্য সুবিধাগুলো সত্ত্বেও আমাদের মনে রাখতে হবে, ওপেনএআই হলো একটি প্রাইভেট, মুনাফার উদ্দেশ্যে স্থাপিত কোম্পানি। তাদের স্বার্থ ও বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতাগুলো বৃহত্তর সামাজিক প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে।
চ্যাটজিপিটির ফলে যে গোপনীয়তার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে, একে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা উচিত। এ ধরনের টুলকে কোন কোন তথ্য দেব, সে সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
- সূত্র: দ্য কনভারসেশন