সাবনিভিয়াম: বরফ-মাটির মিলনস্থলে রহস্যময় এক জগতের গল্প
প্রতি শীতে উত্তর গোলার্ধের একটা বড় অংশ বরফে ডুবে যায়। তুষারের রাজ্যে জীবনযাপন থেমে গেলেও এ বরফই নতুন একটি বাস্ততন্ত্র সৃষ্টি করে। সাবনিভিয়াম নামক এ বাস্তুতন্ত্রটি নিয়ে জানিয়েছে স্প্যানিশ গণমাধ্যম এল পাইস।
বরফের স্তর ও ভূপৃষ্ঠের মাঝখানের অংশে গড়ে ওঠে এ সাবনিভিয়াম। বাইরের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস, এমনকি শূন্যের চেয়ে ২০ বা ৩০ ডিগ্রি কমে গেলেও সাবনিভিয়ামে বাস করা প্রাণীদের কোনো অসুবিধা হয় না।
সাবনিভিয়াম গঠনের জন্য মাটির ওপর বরফের স্তর আট ইঞ্চি হতে হয়। বরফ যত হালকা ও পেঁজা হবে, সাবনিভিয়ামের গঠন তত ভালো হবে। বরফ মাটিতে জমাট বাঁধার পর মাটির ভেতর থেকে উষ্ণ বাতাস বের হয়ে আসে। এ বাতাসের দরুন বরফের স্তরের নিচের অংশ বাষ্পে পরিণত হয়।
এ বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বরফের ভেতর মাটির পৃষ্ঠতল থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে ছোট ছোট গর্ত তৈরি করে। এভাবে গর্ত, চলাচলের পথ ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠে সাবনিভিয়াম বাস্তুতন্ত্র। বরফের নিচে ছোট্ট এ দুনিয়া হয়ে ওঠে ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণীর শীতকালীন আশ্রয়স্থল ও টিকে থাকার অবলম্বন।
পুরো শীতকালজুড়ে সাবনিভিয়াম বাস্তুতন্ত্রে বাস করে গুবরে পোকা (বিটল), স্প্রিংটেইল, মাকড়সা, ও বিভিন্ন ধরনের মাছি। বাইরের তাপমাত্রা যতই কমুক না কেন, অথবা তুষারঝড়ে ওপরের পৃথিবী উলট-পালট হয়ে গেলেও সাবনিভিয়ামের ভেতরে বাস করা প্রাণীদের তা-তে কোনো 'ভ্রুক্ষেপ' হয় না।
বরফের নিচের পরিবেশ তখন এমন হয়ে ওঠে যে, মনে হয় ওই ছোট্ট দুনিয়ায় শীত হঠাৎ করে থমকে গেছে। সাবনিভিয়ামের ভেতরে বাতাসের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। অন্যদিকে তাপমাত্রাও থাকে স্থির — হিমাঙ্কের আশেপাশেই অবস্থান করে এটি।
পুরো পরিবেশটিতে আলোরও কমতি হয় না। বরফের মধ্য দিয়ে বাইরের আলো গভীরে প্রবেশ করতে পারে। ওই আলোতেই সাবনিভিয়ামের মস ও গুল্ম সালোকসংশ্লেষণ করে থাকে। কিছু কিছু উদ্ভিদ তো বরফের সমাধিতে থেকেই ফুলের জন্ম দেয়।
সাবনিভিয়ামের ফাঁকা টানেলগুলো দিয়ে ছুঁচো ও ইঁদুরেরা ঘোরাফেরা করতে পরে। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী ধরার জন্য বেজিরা মাঝেমধ্যে এসব টানেলের ভেতরে ঢুকে লুকোচুরিও খেলতে পারে। বাইরের ধু ধু প্রান্তরে বিচরণ করা খ্যাঁকশিয়ালেরা অনেক সময় লাফিয়ে উঠে বরফে মুখ ডুবিয়ে সাবনিভিয়ামের বাসিন্দাদের শিকার করে।
শীতের আগের ঝরাপাতা বরফের নিচে আটকা পড়ে। এসব পাতায় শীতঘুম দিয়ে কাটায় ব্যাংয়ের দল। উত্তর আমেরিকার কিছু ব্যাং শীতের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিখ্যাত। এমনিতে বেশিরভাগ ব্যাং জমে যাওয়া ঝরনাধারা ও হ্রদের তলায় ঘুমিয়ে শীতযাপন করলেও, কিছু প্রজাতির ব্যাং শীত থেকে বাঁচতে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করে।
আলাস্কান কাঠ ব্যাঙ সাবনিভিয়ামের নিচে পাতার ভেতরে বাসা বাঁধে। শীতের সময়ে কখনো কখনো এগুলো বরফের টুকরোর মতো হয়ে যায়। ব্যাংগুলোর শরীরের দুই-তৃতীয়াংশ পানি বরফে পরিণত হয়, অবশ্য এতে ব্যাংয়ের কোনো শারীরিক ক্ষতি হয় না।
শরীর জমে যাওয়া একটা সময় পর রক্তও জমাট বেঁধে যায়। ফলে প্রাণীর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছানোর কোনো উপায় থাকে না। বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রে এ ধরনের ফ্রস্টবাইট শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গের বড় ক্ষতিসাধন করে, এমনকি মৃত্যুও ঘটায়। কিন্তু কিছু ব্যাং এমন নিয়তি এড়িয়ে যেতে পারে; এগুলো টানা আটমাস বরফে জমাট বাঁধার পর বসন্তে আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
এমনটা তারা কীভাবে করে? শীতের শুরুতে ব্যাংগুলো তাদের যকৃতে বিপুল পরিমাণ গ্লুকোজ উৎপাদন করে। এ গ্লুকোজ কোষের ভেতর ঘনত্ব লাভ করে এবং জমাট বাঁধার বিরুদ্ধে কাজ করে। এর ফলে শরীরের কোষগুলো যেমন শুকিয়ে যায় না, তেমনি কোষের ভেতরটা জমে যাওয়া থেকেও রক্ষা পায়।
কিন্তু রক্তপ্রবাহের মধ্যে থাকা নিউক্লিওপ্রোটিন বরফের জমাট বাঁধা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই তাপমাত্রা যখন হিমাঙ্কের নিচে চলে যায়, তখন কোষের চারপাশে থাকা তরল ও শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জমাট বেঁধে যায়। ব্যাংগুলোর শরীর পুরোটাই শক্ত হয়ে যায়। এগুলোর পেশি নড়ে না, হৃৎপিণ্ড লাফায় না, শ্বাসপ্রশ্বাসও চলে না।
অর্থাৎ পুরো ব্যাংটিই তখন একটুকরো বরফে পরিণত হয়। কিন্তু প্রাণীটি তখনো জীবিত থাকে। সাবনিভিয়ামের ভেতরে এভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে বসন্তের আগমনের অপেক্ষা করে এটি।
তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে সবার প্রথমে ব্যাংয়ের হৃৎপিণ্ড কাজ করতে শুরু করে। এরপর মস্তিষ্কের কার্যক্রম শুরু হয়। সবশেষে ব্যাং এর পেশিগুলো নাড়াতে শুরু করে। শীতঘুমের পর প্রজননের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত পরিবেশ খোঁজা শুরু করে এটি।
শীতের পরে প্রথম জলজ প্রাণী হিসেবে প্রজননে অংশ নেয় এগুলো। এত দীর্ঘদিন নিশ্চল থাকার পরে এ প্রাণীগুলোর হৃৎপিণ্ড কীভাবে আবার কাজ শুরু করে, তা বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝতে পারেননি। আবার রক্তে এরা গ্লুকোজের পরিমাণ ১০০ গুণ বাড়িয়ে তোলার পরেও কেন ডায়াবেটিকসের মতো কোনো সমস্যা হয় না, এ প্রশ্নের উত্তর এখনো মানুষ জানতে পারেনি।
তাহলে কি সাবনিভিয়ামের গোপন দুনিয়ায় আমাদের জন্য ডায়াবেটিকস বা হৃৎরোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর অচল হয়ে যাওয়া অঙ্গ নিয়ে কোনো সমাধান লুকিয়ে আছে?