বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকিংয়ে সুশাসন জরুরি: গোলটেবিলে অর্থনীতিবিদরা
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেলেও এখন আমরা যে অবস্থার মধ্যে আছি সেটি আশঙ্কাজনক নয়। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। আর দেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে ব্যাংকিং সেক্টর। তাই বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে এই খাতে সুশাসন বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে দক্ষ জনবল তৈরি করার প্রতি জোর দেন অর্থনীতিবিদরা।
শনিবার রাজধানীর ঢাকা গ্যালরিতে এডিটরস গিল্ড অয়োজিত 'অর্থনীতি কি সামলে উঠছে?' শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন এই অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, 'অতি-সাম্প্রতিক মুডি'স পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে, কিন্তু ২০২৩ সাল নাগাদ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি হবে। উন্নত দেশগুলোও চলমান মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্থরতার শিকার, এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ৫ শতাংশ গ্রোথ (প্রবৃদ্ধি) খুব খারাপ নয়'।
তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতি আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে যখন মূল্যস্ফীতি বহির্বিশ্বের কারণে হয়, অভ্যন্তরীণ কোনো নীতি অনুসরণ করে- সেটিকে কমানো বেশ কঠিন। সামগ্রিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে যদি আমরা মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করি, তাহলে সেটি প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে,' যোগ করেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক সমস্যা। এই সেক্টরের গভর্নেন্স নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। ঋণখেলাপির মাত্রা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। যে ঋণটা রিশিডিউল করা হলো, সেটি খেলাপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। মামলার কারণে খেলাপির তালিকায় নাম স্থগিত হলে, সেটিও খেলাপি দেখানো হয় না।'
তিনি বলেন, 'অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে ক্যাপিটাল এন্ড লেবারের সমন্বয় হলে, উৎপাদন বাড়ে, এতে করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ে।'
মির্জা আজিজ বলেন, 'আমাদের যে স্টক এক্সচেঞ্জ, সেটি এখনো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাই ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব থাকলে আমাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি হবে না। বেসরকারি গত এক দশক ধরেই ২২/২৩ শতাংশের মধ্যেই আছে। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।'
তিনি বলেন, 'আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে কাজ করার মতো কর্মউপযুক্ত বয়স সম্পন্ন জনসংখ্যা অনুপাতিক হারে বেশী। এই জনবলকে দক্ষ করে গড়ে তোলার উপযুক্ত উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণের যে কর্মক্ষমতা আছে সেটিকে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষিত করতে হবে।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনা আছে। হতাশার জায়গা হলো, সেই সম্ভাবনার জায়গা কি শুধু সম্ভাবনার জায়গায় থেকে যাবে! সেই সম্ভাবনা বর্তমান হবে কখন।'
তিনি বলেন, 'সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে আমাদের কিছু হোমওয়ার্ক করতে হতে দ্রুত। আমাদের দেশে আয় ও সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এই সময়ের হাই-ইনফ্লেশনের অভিঘাতটা সবচেয়ে বেশ পড়ছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। ফলে আয় বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য আরো বাড়ছে।'
'অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আমরা আরো কিভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারি, সেই জায়গাটায় জোর দিতে হবে নীতি-নির্ধারকদের। সেটি সোস্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রাম দিয়ে কাভার সম্ভব নয়। এই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা যে কর্মসংস্থান তৈরি করবো সেটি ভালো কাজ দেবে। এজন্য জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার বিকল্প নেই।'
তিনি বলেন, 'আমাদের ইন্সটিটিউশনগুলোর মধ্যে গুড গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে ভালো অর্থনৈতিক শক্তি গড়ে উঠবে এবং চলমান সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে।'
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি কিন্তু একটি সন্ধিক্ষণেও আছি। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এবং গণমাধ্যম আমাদের প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ হিসেবে বলছে -দুর্নীতি। এটিকে অস্বীকার কারার কোনো উপায় নেই। এটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের মূল্যস্ফীতি যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এখানই সেটি বন্ধ করতে হবে। এই সন্ধিক্ষণে আমাদের এই যাত্রা থেকে কাম-ব্যাক করতে হবে। এছাড়াও অর্থনৈতিক পলিসির পুনর্গঠিন করতে হবে। যাতে করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।'
গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও এডিটরস গিল্ডের কাযনির্বাহী সদস্য সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।