রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি কম, আর্থিক ভারসাম্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে—অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত—রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এ সময় রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এতে কীভাবে ঘাটতি পূরণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে—কারণ বছরের বাকি সময়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনাও কম।
গত বছরের নভেম্বর থেকে রাজস্ব আদায়ে এই ভাটা শুরুর পর সেই ধারা অব্যাহত ছিল ফেব্রুয়ারিতেও। ফেব্রুয়ারিতে এসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি জানুয়ারির ৪.৯১ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে ঠেকেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্র অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারিতে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কাস্টমস শুল্ক-কর মিলিয়ে মোট আদায় হয়েছে ২৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২৩ হাজার ২০ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায় এভাবে ক্রমাগত কমার কারণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগসহ রাজস্ব আদায়কারী মূল প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের (এনবিআর) এর সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।
রোববার এক প্রাক-বাজেট সভায় শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে জন্য কর ব্যবস্থায় সংস্কার আনার পরামর্শ দেন। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম।
অর্থনীতির মূল সমস্যাগুলো সমাধানে আগামী বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাজস্ব ঘাটতি হলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ প্রদানের জন্য সরকারকে আগে থেকেই চাপে থাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে আরও বেশি টাকা ধার করতে হবে এবং আরও বেশি সুদ দিতে হবে।
ইতিমধ্যে সরকার বৈদেশিক সহায়তার অংশ কমিয়ে দিয়ে এডিপিতে বরাদ্দ ৭.৫ শতাংশ কমিয়ে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টানার নিচে নামিয়েছে। কিন্তু দেশীয় উৎস থেকে বরাদ্দ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকার মতোই রয়ে গেছে। এর অর্থ, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ সম্পদের ব্যবধান কমাতে এবং কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে আইএমএফের শর্ত পরিপালনের জন্য কর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য চাপে থাকবে।
তা না হলে সরকারের জন্য একমাত্র বিকল্প হবে ব্যাংক ঋণ নেওয়া বাড়ানো, কারণ সীমিত বাস্তবায়ন ক্ষমতার কারণে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ কমে গেছে।
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা, পুরো অর্থবছরের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
বিগত মাসগুলোর ন্যায় আগামী মাসগুলোতেও আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগে পরিবর্তন না আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই অর্থবছরের বাদবাকি মাসগুলোতে রাজস্ব আদায় বাড়ার সুযোগ নেই। বরং এই প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা কমতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ অবস্থায় দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ার পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কমে যেতে পারে বলে মনে করছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রাজস্ব আদায় কম হওয়ার ফলে ব্যাংক ঋণ বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তও পূরণ হবে না, যা সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া কঠিন করে তুলতে পারে।'
তবে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের কাছাকাছি। গত বছরের একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল আলোচ্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মহামারিজনিত লকডাউনের কারণে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ২ শতাংশ। তবে পরবর্তী দুই অর্থবছরেই গড়ে ১৬ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো মুনতাসির কামাল টিবিএসকে বলেন, 'আমদানিতে লিখিত-অলিখিত বিধিনিষেধ ছিল মূলত দেশে ডলার সংকটের কারণে। যার কারণে আমদানিতে শুল্ক-কর আদায় ব্যাপকভাবে কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য আগামীতেও একই অবস্থা অব্যাহত থাকলে রাজস্ব বর্তমান প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা কমে আসতে পারে।'
এই পরিস্থিতিকে অর্থনীতির গতিমন্থরতাই (স্লোডাউন) বলা যায় বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের জিডিপিতে রাজস্বের অবদান (কর-জিডিপি অনুপাত) বৈশ্বিক বিবেচনায় তলানিতে। এমন সময়ে আইএমএফ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্তও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো কর-জিডিপি অনুপাত আগামী ২০২৩-৩৪ অর্থবছরে ০.৫ শতাংশ বাড়ানো।
মুনতাসির কামাল বলেন, 'ট্যাক্স এক্সপেন্ডিচার কমিয়ে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর মতো শর্ত মানাও কঠিন হয়ে যাবে।'
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বাড়তে থাকায় ডলারে টান পড়ায় সরকার গত বছরের এপ্রিল থেকে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নয়। ওইসব বিধিনিষেধ পরবর্তীতে নমনীয় না হয়ে বরং কিছু ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে। এর ফলে ক্রমাগত কমছে আমদানি।
ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি কমেছে ৫.৭ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। গত জানুয়ারিতে আমদানি শুল্ক আদায়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায়ের তিনটি খাতের মধ্যে আমদানি শুল্ক আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে কম, ৪ শতাংশের সামান্য বেশি। ভ্যাট ও আয়কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১৫ শতাংশ ও ৬.২৯ শতাংশ।
ভ্যাট আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি হওয়ার মূল কারণ আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বলে মনে করছেন সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ এনবিআরের
রাজস্ব আদায়ে প্রত্যাশিত গতি না আসা এবং আদায় বাড়ানোর উপায় খুঁজতে রবিবার মাঠ পর্যায়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
ওই সভায় রাজস্ব আদায়ে গতি না আসার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সভায় উপস্থিত এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'আমদানি কমায় রাজস্ব আদায় বাড়ানো চ্যালেঞ্জিং হয়েছে। তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), পেট্রোবাংলাসহ যাদের কাছে বড় অঙ্কের বকেয়া রয়েছে, তা আদায়ে মনযোগী হওয়া এবং মামলা দ্রুত নিষ্পিত্তির মাধ্যমে আদায় বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।'