যুদ্ধবিপর্যস্ত বিশ্ব চীনের ইউক্রেন শান্তি প্রস্তাব মেনে নিতে পারে বলে ভয় যুক্তরাষ্ট্রের
মস্কোতে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শি জিনপিংয়ের বৈঠক বাইডেন প্রশাসনকে এক অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী একসাথে বসে ইউক্রেনে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব উত্থাপন করেছে, যেটি মার্কিনদের কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা চীনের প্রস্তাব সম্পর্কে জনসমক্ষেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এই অবস্থায় যুদ্ধবিরতির ফলে ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নেওয়া জায়গা রাশিয়ানদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে, যার ফলে লাভ হবে রাশিয়ানদেরই। যদিও বৈঠক আর প্রস্তাব বাইডেন প্রশাসনের ভেতরে আরও অস্থিরতা তৈরি করেছে। রাশিয়া আর চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কীরূপ হবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা গিয়েছে প্রশাসনের মধ্যেই।
একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছেন, চীনের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র কোণঠাসা হওয়ার ভয় পাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেও দেয়, তাহলে চীনের হাতে সুযোগ থাকবে যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাছে গিয়ে প্রস্তাবে রাজি করানো। তারা এও বলতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রস্তাবে আগ্রহী নয়।
পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা বনি লিনের মতে, যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব না মেনে নেয়, "তবে চীন সবাইকে বলে বেড়াবে যে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির পক্ষে নয়, তারা যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে নয়। চীন-রাশিয়া বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন উপায়ে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে পারে চীন।"
শি জিনপিংয়ের তিন দিনের রাশিয়া সফরের সময় চীনা নেতাকে আন্তরিকভাবে অভিবাদন জানান ভ্লাদিমির পুতিন। দুই দেশই নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশ অস্বস্তিদায়ক।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকেই বাইডেন প্রশাসন চীনকে সাইডলাইনে রাখার চেষ্টা করেছে, তবে ঠিক এর উল্টো ফলাফল দেখা গিয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। শি আর পুতিনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার ছাড়াও চীন সারাবিশ্বে কূটনীতিক প্রভাব বাড়াচ্ছে।
এদিকে শি-এর রাশিয়া সফর এবং দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর একত্রে যোগদান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন বলেন, "এটা কোনো আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় নয়, দুটো দেশেরই বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেয়ে ভিন্ন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিরোধিতা করার মধ্যে দিয়ে তারা নিজেদেরকে একই অবস্থানে খুঁজে পেয়েছে। আমাদের মতো মতাদর্শের দেশগুলোকে নিয়ে তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে।"
অনুরোধ সত্ত্বেও কোন দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দেয়নি, তাদের নাম বলতে রাজি হননি ব্লিঙ্কেন।
নিজেদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ এড়িয়ে চীন রাশিয়ার সাথে অংশীদারিত্ব বাড়িয়েছে, পশ্চিমাদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ইরানের কাছ থেকে তেল কিনেছে এবং সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার কূটনীতিক সম্পর্ক তৈরি করতে মধ্যস্থতা করেছে। ভারত আর ব্রাজিলের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোন পক্ষ নিতে নারাজ, কারণ তারা চাইছে না আবার কোনো নতুন স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হতে।
এক সপ্তাহ আগেই হন্ডুরাস চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য তাইওয়ানের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট শিওমারা ক্যাস্ট্রো জানিয়েছেন এই পদক্ষেপ 'সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতি আমার সংকল্প ও সারাবিশ্বের দেশগুলোর সাথে মুক্তভাবে সম্প্রীতি বজায় রাখার চিহ্ন'।
দুর্বল বন্ধন
চলমান ঘটনাগুলোর সবকিছুই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বন্ধন দুর্বলতর হওয়ার সাথে সাথে, যেটা শুরু হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধের মাধ্যমে। সম্পর্ক আরও খারাপ দিকে মোড় নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনা স্পাই বেলুনের ঘটনায়, যেটিকে কেন্দ্র করে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ব্যাপক বাদানুবাদ হয়েছে।
গত বছরের শেষদিকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার জন্য ইন্দোনেশিয়ায় জো বাইডেন এবং শি জিনপিংয়ের বৈঠকের পরও দুই দেশের সম্পর্কে তেমন পরিবর্তন আসেনি। এরপর মিউনিখে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং ওয়াং ইয়ের এক উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠকের পর শি 'যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনের ওপর পশ্চিমাদের দমনমূলক মনোভাব'-এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেন।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন চীনের প্রতি তাদের কর্কশ বক্তব্যগুলো প্রভাব ফেলছে। রাশিয়াকে মারণাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার প্রতি সতর্ক করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তাদের এই উদ্যোগ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা উচিৎ। এদিকে ইউক্রেনের প্রতি অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, এই সপ্তাহেই ৩২৫ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে তারা। তাদের ইউরোপীয় মিত্ররাও নিজস্ব সাহায্য পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে বিশ্লেষণ করা চায়না স্ট্র্যাটেজিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফার কে. জনসন জানিয়েছেন, বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন সংকটের ব্যাপারে চীনকে নিজেদের শর্ত মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিল, তবে 'শি এখন নিজেই নিজের শর্ত তৈরি করছেন।' "আর আমার মনে হয়, এর ফলে বাইডেন প্রশাসনের মধ্যে এক হতবুদ্ধিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।"
ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের প্রতি বারবার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনসের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গবেষক মেলানি সিসনের মতে, "চীন যতই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করার সুযোগ কমতে দেখবে, ততই তারা অন্য রাস্তার দিকে ঝুঁকবে। এবং অনেক জায়গাতেই তারা এর মাধ্যমে অন্য দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভাঙন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে।"
সূত্র: ব্লুমবার্গ