চর জাগছে মেঘনা নদীতে: নৌযান চলাচলে ভোগান্তি, কমে গেছে ইলিশ
লক্ষ্মীপুর এবং ভোলা জেলার মাঝামাঝি মেঘনা নদীতে ব্যাপক হারে জাগছে অসংখ্য ভাসমান ও ডুবোচর। এতে লঞ্চ, ফেরী এবং সাধারণ নৌকা চলাচলেও বিঘ্ন ঘটছে। ডুবোচরের কারণে নদীর গভীরতা কমে কমে গেছে ইলিশ। অন্যদিকে নদীতে চরের কারণে নদীর স্বাভাবিক জোয়ারেও পানি উপকূলে উঠে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে বহু জনপথ, ভাঙ্গছে নদীর তীর। মেঘনাপাড়ের ২০-২৫ জন বাসিন্দা, ফেরী ও লঞ্চচালক, জেলে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
এসময় স্থানীয়রা জানায়, গত ৫-৭ বছরের মধ্যে চাঁদপুর সীমানা থেকে একেবারে নোয়াখালীর হাতিয়া পর্যন্ত মেঘনা নদীর বিশাল এলাকায় অসংখ্য চর দৃশ্যমান হয়েছে এবং আরো অজস্র ডুবোচর তৈরি হয়েছে। নদীতে চরের কারণে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
মেঘনায় জাগছে চরের পর চর
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার জেলে সাজু মাঝি, মো. হোসেন এবং কমলনগর উপজেলার জেলে সিরাজ। এ তিন জেলে মেঘনায় প্রায় ৪০ বছর যাবত মাছ ধরেন। তারা জানান, মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর অংশে প্রচুর চর পড়ছে। এতে লক্ষ্মীপুরের অর্থনীতিতে নানা প্রতিকূলতা তৈরি হয়েছে। চরের বর্ণনা দিতে গিয়ে জেলেরা জানায়, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের উত্তর সীমানা চর ভৈরবী থেকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার এলাকায় দীর্ঘ একটি চর দৃশ্যমান হয়েছে। প্রায় ৮ কিলোমিটার প্রস্থের এ চরটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নাম ধারণ করেছে।
এছাড়া কমলনগর সীমান্তে মাতব্বরহাট সংলগ্ন এলাকায়, নাসিরগঞ্জ, পাটারিহাট, লুধুয়া, বালুর চর এলাকায় একটি করে চর জাগছে। রামগতির আলেকজান্ডার বাজারের দক্ষিণে ৩টি এবং রামগতি বাজার সংলগ্ন ২টিসহ লক্ষ্মীপুর জেলার ৭৬ কিলোমিটার মেঘনা এলাকায় গত ৫-৭ বছরের মধ্যে ১০টি চর দৃশ্যমান হয়েছে। এ চরগুলোর বেশিরভাগই এখন চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। অন্যদিকে রামগতি থেকে নোয়াখালীর হাতিয়া পর্যন্তও চর রয়েছে।
জেলে সাজু মাঝি জানায়, দৃশ্যমান এ চরগুলো ছাড়াও কমলনগরের মতিরহাট থেকে রামগতির টাংকি বাজার পর্যন্ত অন্তত আরো ৬টি বড় বড় ডুবোচর রয়েছে । যেগুলো বর্ষায় দেখা না গেলেও শীত মৌসুমে ভাটার সময় দেখা যায়। পুরো মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর সীমানায় এখন অসংখ্য চর।
মেঘনায় চরের কারণে কমে গেছে ইলিশ
মতিরহাট ঘাটের মাছের আড়তদার মিছির আহমেদ জানান, বর্তমানে মেঘনা নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশের জন্য জেলেদেরকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে সাগরে যেতে হচ্ছে। সাগর থেকে ইলিশ এনে জেলেরা নদীর ঘাটে বিক্রি করছে। বর্ষায় নদীতে প্রচুর ইলিশ আসে না। ২০২৩ সালের শীত মৌসুমে মেঘনায় ইলিশ পায়নি জেলেরা। দু'চারটি করে ইলিশ পেলেও তাতে নৌকার জ্বালানি খরচও ওঠে না।
এসময় রাশেদ নামে অপর একজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, গত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে ইলিশ কমে গেছে প্রায় ৬০-৭০ ভাগ। তবে এসময় বিগত বছরগুলোর তুলনায় মেঘনার এ সীমানায় পোয়া ও রিঠা মাছ বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ।
জেলে সহিজল মাঝি জানায়, মৌসুমে ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলে, আড়তদার, পাইকার, দাদন ব্যবসায়ী, মৎস্য শ্রমিক ও জেলে পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে বিষাদের চাপ।
চরের কারণে ইলিশ ধরা না পড়ায় মেঘনাপাড়ের অর্থনীতে পড়ছে ছাপ
নদীতে চরের কারণে ইলিশ কমে যাওয়ায় লক্ষ্মীপুরের উপকূল এলাকায় অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন বাংলা বর্ষের জন্য কমলনগরের মতিরহাট, মাতব্বরহাট এবং পাটারিরহাট বাজার ইজারায় কেউ অংশ নেয়নি। মতিরহাট বাজারের ব্যবসায়ী ও চর কালকিনির ইউপি সদস্য মেহেদী হাসান লিটন জানান, মেঘনায় ইলিশ ধরা না পড়ায় এসব বাজারে এখন ক্রেতা ও বিক্রেতা আসে না। তাই বাজার ইজারায় কেউ অংশ নেয়নি। গত ২-৩ বছর আগেও এ বাজারগুলোতে ৫-৭ লাখ টাকার ইজারা হতো বলে জানান তিনি।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরে নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৪২ হাজার। কিন্ত গত ২ বছর যাবত নদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলেদের জীবিকা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে সৃষ্ট বহু চর ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশ মিঠাপানিতে আসতে বাধা পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করছে। সামনে এ অবস্থা চললে মেঘনা ইলিশশূন্য হয়ে যাবে। নদীতে চর পড়ে গেছে এবং পানি কমে গেছে। তাই ইলিশ মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। পানি বাড়লে ইলিশের পরিমাণও বাড়বে।
নৌ-যোগাযোগে ব্যাপক বিঘ্ন
ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীহাট রুটের তিন যাত্রী মো. পলাশ, শিমুল পাটোয়ারি এবং তাহসিন হাওলাদার জানান, লক্ষ্মীপুরের পশ্চিম এবং ভোলা জেলার পূর্বদিকে মেঘনা নদীর মাঝে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে অসংখ্য চর পড়ার কারণে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। প্রায়ই ডুবোচরে ট্রলার, লঞ্চ এবং ফেরী আটকে গিয়ে মাঝনদীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষা করে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে চলাচলকারী ২১ জেলার যাত্রীরা।
লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট থেকে প্রতিদিন ভোলার ইলিশায় এবং বরিশালে ৫টি ফেরী ও ১০টি বড় লঞ্চ, রামগতির আলেকজান্ডার থেকে চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমদ্দিনে ৬টির মতো লঞ্চ চলাচল করে।
লঞ্চ দোয়েলপাখির মাস্টার মো. আরিফুল রহমান আরমান জানায়, 'গত ২ বছর আগে ইলিশা থেকে মজুচৌধুরীহাট ঘাটে যেতে লঞ্চে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো। এখন আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগছে। যদি চরে লঞ্চ আটকে যায় তাহলে জোয়ারের জন্য আরো ২-৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। নদীতে অসংখ্য ডুবোচরের কারণে লঞ্চ চরে আটকে পড়ার ভয়ে ঘুরে যেতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে। ডুবোচরের কারণে লঞ্চের ২৩ কিলোমিটারের পথ ৩১ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়।'
কিষাণী ফেরির মাস্টার মো. আতিকুর রহমান বলেন, 'ডুবোচরের কারণে আমরা ঠিকমতো ফেরি চালিয়ে যেতে পারি না। ঘুরে গেলেও ডুবোচরে আটকা পড়ে ফেরি। পরে জোয়ারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করি।' গত দুই-তিন বছর যাবত শীত মৌসুমে এ সমস্যা বেশী দেখা দিয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের কার্গো জাহাজের নাবিক মো. কামাল হোসেন জানান, গত বছরও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে সন্দ্বীপ ও ভাসানচরের দক্ষিণ দিয়ে হাতিয়ার উত্তর সীমানা হয়ে লক্ষ্মীপুরের সীমানাকূল ঘেঁষে চলে যেত। কিন্ত গত প্রায় এক বছর যাবত ঢাকা-চট্টগ্রামগামী জাহাজগুলো লক্ষ্মীপুর সীমান্তে মেঘনা নদী দিয়ে যাতায়াত করতে পারছে না। এখন বড় বড় জাহাজগুলো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতে ভোলার তজুমদ্দিন, দৌলতখান, ইলিশা, মেহেদীগঞ্জ হয়ে ঢাকা যাচ্ছে। এতে প্রচুর সময় ও জ্বালানী পুড়ছে।
উপকূলে প্লাবন বাড়ছে
রামগতি উপজেলার নদীপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা মিশু সাহা নিক্কন এবং কমলনগর উপজেলার আবদুর রহমান বিশ্বাস জানান, গত ৪-৫ বছর যাবত জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত নদীর স্বাভাবিক জোয়ার হলেও পানি লোকালয়ে চলে এসে তৈরি হয় প্লাবন। এতে রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর এবং রায়পুর উপজেলার স্থানীয় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষতিসহ ব্যাপক হারে নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। তারা আরো জানায়, বর্তমানে প্রতি বছরই নদীর পানিতে লবণ বাড়ছে। তাদের ধারণা পানিতে লবণ আসাও নদীর চরের কারণে।
ড্রেজিংয়েও হচ্ছে না সমাধান
বিআইডব্লিউটিসির কার্যালয় থেকে জানা গেছে, মেঘনায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার চর পড়লেও শুধুমাত্র লক্ষ্মীপুর ও ভোলা রুটে নৌ যোগাযোগ ঠিক রাখতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২৫ কিলোমিটার নদীপথ খননের উদ্যোগ নেয় সরকার। ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে মজুচৌধুরীর হাট থেকে চর রমণীমোহন এলাকায় মেঘনার লোয়ার চ্যানেলে ড্রেজিং কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ খনন কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিষাণী ফেরির মাস্টার মো. আতিকুর রহমান জানান, ২০২৩ সালে এসে এখনো খনন চলছে। আবার আমাদের ফেরীও আটকে যাচ্ছে। ড্রেজিং কোন কাজে লাগছে না বলেও জানান তিনি।
মেঘনায় চরের বিষয় জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-এর ভোলা নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, শুধুমাত্র ভোলা-লক্ষ্মীপুরই নয়, পুরো মেঘনা নদীতে ড্রেজিংয়ের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
বেসরকারি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা প্রয়াসের নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, নদী অববাহিকায়ও জেগে ওঠা অসংখ্য চর দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করবে। চর জাগায় নদীর তলদেশে ঢাল তৈরি হয়েছে। এতে পানির প্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে। পানি স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাহিত হতে না পেরে দ্রত ছড়িয়ে পড়ছে নদীতীরে। এতে নদী তীর ভাঙ্গছে এবং লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে তিনি নৌ-সীমানায় মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা চরগুলোতে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।