‘অধিকাংশ বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্ম জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে’
রাষ্ট্রায়ত্ব জনতা ব্যাংক জন্মলগ্ন থেকে এদেশের শিল্পখাতের বিকাশে অসামান্য অবদান রাখছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের প্রায় ৮০% শিল্পখাতে রয়েছে। ওরিয়ন, বসুন্ধরা, এস আলম, টিকে গ্রুপ, আবুল খায়ের, এপেক্স ফুটওয়্যার, আকিজ গ্রুপের ব্যবসা এই ব্যাংকের মাধ্যমেই শুরু হয়েছে; এখনও তারা জনতা ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। দেশের অধিকাংশ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্ম ও উৎপত্তি জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে। টিবিএস এর স্টাফ কারেসপন্ডেন্ট শাখাওয়াত প্রিন্সের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকালে এসব কথা বলেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুস সালাম আজাদ।
জনতা ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগদানের সময়টা কেমন ছিল
আমি ২০১৮ এর শুরুতে যোগদান করি। যোগদানের শুরুতে বড় দুটি প্রতিষ্ঠানের আগে হওয়া ঋণ অনিয়ম (এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট) এর ভার আমার উপরে পড়েছে। ২০১৮ সালে এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট এর ঋণগুলো খেলাপি হওয়ায় খেলাপি ঋণ ৯ হাজার থেকে হুট করে বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা হয়। অনেক লোকজন মন্তব্য করেছেন আরেকটি সরকারি ব্যাংকের ন্যয় জনতা ব্যাংকও ডুবতে বসেছে।
আমাদের ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংকগুলোর (যাদের সঙ্গে ক্রেডিট লাইন রয়েছে) যেমন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মাশরেক ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকগুলো জনতা ব্যাংকের এসব ঋণের বিষয়ে বারবার জানতে চেয়েছে। আমরা তাদেরকে আশ্বস্ত করেছি, আপনারা জনতা ব্যাংকের সঙ্গে যে সম্পর্ক রয়েছে তারচেয়ে ভালোভাবে থাকেন, নিশ্চিত প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াবে। এখন প্রতিটি সূচকেই ২০১৮ সালের পর থেকে বহুগুণ উন্নতি হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল পারফরমেন্স কেমন
২০১৮ সালে জনতা ব্যাংকের অপারেটিং প্রফিট মাইনাস ছিল। ২০১৯ সালে অপারেটিং প্রফিট করেছি ৭০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে এসে অপারেটিং প্রফিট হচ্ছে ১৪০০ কোটি টাকার বেশি। একইসঙ্গে নিট প্রফিট ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ২৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালে হয়েছে ৩০০ কোটি, গত বছরে আরও বেড়ে হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা।
একইসঙ্গে আমদানি, রপ্তানি এবং আমানত ও ঋণের পরিমাণ ২০১৯ এর তুলনায় ২০২২ সালে ব্যাপক বেড়েছে। ২০১৯ সালে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৯১৪০ কোটি টাকা, ২০২২ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,০১,৪৬৬ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯ এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সাল শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। ইপিএস (আর্নিং পার শেয়ার) ছিল ২০১৯ সালে ১.৬ টাকা, ২০২২ এ এসে ১৩.৪১ টাকা।
দেশের ডলার সংকটে জনতা ব্যাংকের আমদানিতে কেমন প্রভাব পড়েছে
এই ডলারের সংকটের মধ্যেও আমাদের ইম্পোর্ট ও এক্সপোর্ট এর পরিমাণ ভালো। আমরা চলতি অর্থবছরে (জুলাই থেকে মার্চ) মোট ৫ বিলিয়ন ডলার পণ্য ইম্পোর্ট করেছি। এর মধ্যে সরকারি ইম্পোর্ট প্রায় ৪ বিলিয়ন, বাকিটা বেসরকারি আমদানি ছিল।
অধিকাংশ (৮০%) এলসিই সরকারি সংস্থাগুলো খোলে যেমন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, বাংলাদেশ পুলিশ, সেনাবাহিনী, ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ডিফেন্স পারচেজ (ডিজিডিপি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), পেট্রোবাংলা এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)।
আমাদের কোন ধরণের বিদেশি এলসি পেমেন্টে ব্যর্থ হয়নি। যদিও অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এলসি পেমেন্টে ব্যর্থ হওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমাদের রপ্তানির পরিমাণ অনয়ানয় ব্যাংকের তুলনায় বেশি, এই অর্থবছরে প্রায় দুই বিলিয়নের বেশি রপ্তানি হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমাতে আপনার ভূমিকা কী
আমি খুবই সংকটময় মুহূর্তে জনতা ব্যাংকে এসেছি। আমার কাজ ছিল ব্যাংকের বের হওয়া টাকাগুলো যেকোনভাবে রিকভার করা। ২০১৯ এর পরে খুবই ফ্রেন্ডলি বোর্ড পেয়েছি। ২০১৯ এর আগে আমরা অন্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলাম। জনতা ব্যাংক খেলাপি ঋণের দিক থেকে ১ নম্বরে ছিলাম। একপর্যায়ে আমাদের খেলাপি ঋণ ৪৪% ছিল। ২০১৯ সালে ছিল ২৬%।
গত ৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (এমওইউ) মিটিং ছিল, সেখানে আমাদের খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ১৭% এর কিছুটা বেশি। বর্তমানে অন্য একটি সরকারি ব্যাংকের তুলনায় খেলাপি ঋণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। গত ২০২২ এর সেপ্টেম্বরে আমাদের খেলাপি ঋণ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা, এখন আমাদের খেলাপি ঋণ ১৪,৩০০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আরও কিছু ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছি এবং আগামী ২০২৩ এর জুনের মধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হবে যা পাইপলাইনে রয়েছে।
এননটেক্স এর ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ হয়েছে কি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমওইউ মিটিংয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, জুনের মধ্যে আমাদের খেলাপি ঋণ ১৪% এ নেমে আসবে। এরইমধ্যে এননটেক্সের ৫ হাজার কোটি টাকা নিয়মিত করতে পেরেছি সুদ মওকুফের মাধ্যমে ২% ডাউন পেমেন্ট নিয়ে। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পূর্ণ নীতিমালা ও নিয়মকানুন মেনেই করা হয়েছে।
এননটেক্স'কে আমরা যে পরিমাণে টাকা ঋণ দিয়েছি তার দ্বিগুণ টাকা আদায় করতে পারবো। এবং এই ঋণটা আদায় করতে পারলে আমাদের রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটের পরিমাণ কমে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক্সিট পলিসি অনুযায়ী, এননটেক্সের ঋণটা আদায়ে জুন পর্যন্ত সময় দেয়া রয়েছে। আমাদের এক বছর সময় থাকে সুদ মওকুফে। আমরা আশা করছ্ ছয় মাসের মধ্যে ঋণটা আদায় হয়ে যাবে। এছাড়া পুরোপুরি আদায় না হলে পুনরায় সময় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া ক্রিসেন্ট থেকে আমরা প্রায় সাড়ে তেরো কোটি টাকা আদায় করেছি এই বছরের জানুয়ারি মাসে। তাদের ৩২০০ কোটি টাকার মধ্যে সর্বোচ্চ ৩% ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে ৭০০ কোটি টাকা রেগুলার করতে পেরেছি।
জনতা ব্যাংককে আগামী তিন বছরে কোন পর্যায়ে দেখতে চান
এননটেক্স ছাড়াও দুটো বড় গ্রাহক ঋণ রেগুলার করার প্রক্রিয়ায় রয়েছি। জুনের মধ্যে আমাদের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে চলে আসবে। আমাদের টার্গেট রয়েছে ২০২৪ এর মধ্যে খেলাপি ঋণ সিংগেল ডিজিটে নিয়ে আসা।
আগামী ২০২৫ এর মধ্যে জনতা ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে সেরা ব্যাংক হিসেবে দেখতে চাই, যেটা আগেও ছিল। সেবাগত মান, স্মার্টনেস, ব্যাংক আধুনিকায়নে, অনলাইন কোর ব্যাংকিং সল্যুশন (সিবিএস) বাস্তবায়নে। আমরা ই-জনতা চালু করেছি। যেখানে ঘরে পরে গ্রাহকরা সকল ধরণের লেনদেনের সুযোগ পাবে। এননটেক্সের পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুরোপুরি রিকভারি হয়ে গেলে, এছাড়া আরও বড় কিছু গ্রাহকের ঋণগুলো আদায় করতে পারলে ২০২৫ এর মধ্যে আমরা সেরা ব্যাংক হিসেবে অবস্থান করবো।
বর্তমানের বৈশ্বিক সংকটে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য কী চ্যালেঞ্জ মনে করেন
কোভিডের পরে ২০২২ এর ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যার কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ব্যাপক বৃদ্ধি ও সাপ্লাই চেইন ডিজরাপশন হয়েছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের কারেন্সির ন্যায় দেশের টাকার তুলনায় ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে, এতে তৈরি হয়েছে ডলার সংকট। অনেক উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি যেখানে ১৩% এর বেশি, সে সময়ে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি এখনও সাড়ে ৮%। অনেকে মনে করেছে রমজানে তেল, খেজুর, ছোলা পাবে না, কিন্তু আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজারে স্বাভাবিক রয়েছে।
২০২২ এর জুলাইতে দেশের ডলার বাজারে সে সংকটটা দেখেছি, এখন অনেকটা কমে এসেছে। এখনও আমাদের রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। মার্চে রেমিট্যান্স এসেছে দুই বিলিয়নের বেশি, আগামী কয়েক মাসও বেশি আসবে কারণ দুটা ঈদ সামনে রয়েছে। এখনও আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভালো রয়েছে, আমরা ঋণের টাকাগুলো ফিরে পাচ্ছি।
নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনী (২০২৩) কিভাবে দেখছেন
নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকের বিষয়ে যে নীতিমালা দিয়েছে এটা আমরা দীর্ঘদিন চাচ্ছিলাম। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় সাহস দেখিয়েছে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের তালিকা প্রকাশ করে। তারা রাজনীতির পদবীতে থাকতে পারবে না, বাড়ি, গাড়ি কেনা ও বিদেশে ভ্রমণের শর্তগুলো ভালো দিক বলে মনে করি। এছাড়া ডিরেক্টর লেভেলেও পরিবর্তন এনেছে এটা যুগোপযোগী হয়েছে।
সোশ্যাল সেফটিনেট সেবায় জনতা ব্যাংকের ভূমিকা কী
সারাদেশে আমাদের সোস্যাল সেফটিনেটের মাধ্যমে ৪৩টি সেবা দিচ্ছি উইদাউট কস্টে, যদিও আরও চারটি ব্যাংক এই সেবাগুলোও দিচ্ছে। আমাদের সরকারের কাছে চাওয়া ছিল প্রতি বছর ৭০০ কোটি টাকা এই সেবা খাতে দেয়ার জন্য। যার মাধ্যমে আমাদের মূলধনের যোগান হবে। আমরা বিসিসি, পেট্রোবাংলা এবং পোর্টের যে এলসি খুলসি তা নামমাত্র কমিশনে খুলছে। মাত্র ১০-২০ পয়সা কমিশন দিচ্ছে। জনতা ব্যাংকের সরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আস্থা রয়েছে এবং আগামী দিনেও যাতে এই আস্থা রাখতে পারি সেই প্রচেষ্টা করছি।