রাজশাহীতে তীব্র তাপদাহ, ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ, বৃষ্টির জন্য নামাজ
রাজশাহীতে তীব্র তাপদাহ প্রবাহিত হচ্ছে। তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন; শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষ ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছে। অতিরিক্ত তাপদাহে মানুষ নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তীব্র তাপদাহে রাজশাহীর আম ও বোরো আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলার অনেক স্থানে ধানে চিটা পাওয়া গেছে। গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আমের গুটি।
এমন অবস্থায় রাজশাহীর মানুষকে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে থেকে বের না হতে পরামর্শ দিয়েছেন রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয় কমিটি। এছাড়া এই তীব্র তাপদাহ থেকে বাঁচতে রাজশাহীর অনেক জায়গায় মুসল্লিরা বৃষ্টি চেয়ে সালাতুল ইসতিস্কা আদায় করছেন।
আবহাওয়া অফিস জানায়, রাজশাহীতে গত সোমবার এ মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ওইদিন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০০৫ সালে জুন মাসের ২১ তারিখে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ বুধবার দুপুর ১২টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে ও বাতাসের আর্দ্রতা ছিলো ২০ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক সপ্তাহ ধরে বাতাসের আর্দ্রতা থাকছে গড়ে ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ। ফলে প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়ালেও মানুষের শরীর খুব কম ঘামছে। হাত, পা, মুখ, ঠৌঁট ফেটে যাচ্ছে।
বৈশাখের খরতাপ থেকে রক্ষা পেতে একটু বিশ্রামের আশায় নগরীর মেহেরচন্ডি ফ্লাইওভারের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় তাদের সঙ্গে। বলেন, গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে এসে বিদ্যুতের পোল বসানোর কাজ করছেন তারা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের। বেতন পান প্রতিদিন ৪৫০ টাকা। পেটের দায়ে রৌদ্রের এই অনল বর্ষণ উপেক্ষা করেই কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক শাহ জামাল বলেন, "দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় দুই থেকে তিন ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ থাকছে। এতো গরম যে আগুনের হলকা শরীরে ফুটছে। তীব্র লোডশেডিং আর তাপদাহে ফসল সব শেষ। আমাদের কোনো ফসল আর হবে না।"
'সায়েন্স ডিরেক্ট' নামক প্রকাশনায় 'মডেলিং ফিউচার ল্যান্ড ইউজ: ল্যান্ড কাভার চেঞ্জেস অ্যান্ড দেয়ার ইমপ্যাক্ট অন ল্যান্ড সারফেস টেম্পারেচারস ইন রাজশাহী, বাংলাদেশ' শিরোনামে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, গত দুই দশকে রাজশাহীতে বৃক্ষগুল্ম আচ্ছাদিত ভূমি কমেছে ১৯ শতাংশ আর জলাশয় কমেছে ৪ শতাংশ হারে। সে কারণে এই সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা কার্বন নিঃসরণের শীর্ষে থাকা অঞ্চলগুলোর চেয়েও বেশি।
তাই রাজশাহীতে গত বছরের তুলনায় এ বছরের এপ্রিলে বাতাসের আর্দ্রতা কমেছে ১৬ থেকে ২৫ শতাংশ, যা প্রভাব ফেলছে শরীরে- ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে, শরীরে হচ্ছে জ্বলুনি। বাতাসে জলীয়বাষ্প কমে যাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাতও বিলম্বিত হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে বৃক্ষনিধন ও পুকুর-নদী-জলাশয় ভরাট করে অবকাঠামো উন্নয়নের কারণেই ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রার পারদ বাড়ছে। পদ্মা নদীর পানি পাড় থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন পদ্মা চরে ধুধু বালুচর। তার উত্তাপ এসেও শরীরে লাগছে। এজন্য তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে।
প্রকৃতিতে তাপমাত্রার পারদ কমাতে বেশি করে বৃক্ষরোপণ, কৃষি জমি, পুকুর, নদী, জলাশয় রক্ষা করে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষ টিকতে পারছে না। রাজশাহী জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার একরামুল হক জানান, দুর্গাপুর, মোহনপুর, তানোর, কাঁকনহাট রাতের বেলায় বিদ্যুতের প্রয়োজন ১০০ মেগাওয়াট। সেখানে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় ৫০ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। আর দিনে যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা ৮৫ মেগাওয়াট সেখানে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় ৪০ মেগাওয়াট। এই লোডশেডিং নিয়েই তাদের কাজ করতে হচ্ছে।
তবে সিটিতে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কিছুটা কম বলা যায়। নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ জানান, রাজশাহী সিটিতে যেখানে বিদ্যুতের প্রয়োজন ১০০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট সেখানে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি ৭০ থেকে ৮০ মেগাওয়াট।
এদিকে তীব্র তাপদাহ থেকে পরিত্রাণ পেতে রাজশাহীতে বৃষ্টি চেয়ে সালাতুল ইস্তিসকার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় রাজশাহীর তেরখাদিয়া বিভাগীয় স্টেডিয়ামে সালাতুল ইস্তিসকার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি রাজশাহী জেলা শাখার উদ্যোগে এই সালাতুল ইস্তিসকার আয়োজন করা হয়।
জাতীয় ইমাম সমিতি রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন হামিদী এই নামাজের ইমামতি করেন। নামাজ শেষে তিনি বলেন, "কারো কোন ব্যক্তিগত বিশেষ কারণে নয়, এই নামাজ বৃষ্টির জন্যই বিশেষ দোয়ায় আয়োজন করা হয়েছে। মহান আল্লাহর কাছে আমরা ক্ষমা চেয়ে এই নামাজ আদায় করছি। পাশাপাশি প্রচণ্ড রোদ ও গরম থেকে পরিত্রাণ পেতে নামাজ শেষে মহান আল্লাহর রহমতের বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছি।"
আয়োজকরা বলেন, নামাজ শেষে পুরো দেশ ও জাতির জন্য দোয়া ও বিশেষ করে রাজশাহী জেলাতে বৃষ্টির জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়েছে। এ সময় রাজশাহীর তেরখাদিয়া এলাকার প্রায় ১৪টি মসজিদের আড়াই শতাধিক মুসল্লি নামাজে অংশ নেন।
রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরউল্লাহ জানান, চলমান তীব্র দাবদাহে সুস্থ থাকার জন্য দিনের বেলা অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া, ছায়াযুক্ত স্থানে অবস্থান নেওয়া, প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করা, প্রচুর পানি ও তরল খাবার গ্রহণ এবং চা-কফি জাতীয় খাবার যা শরীরের তাপ বৃদ্ধি করে সেগুলো পরিহার করার জন্য সভায় স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়।