আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে ঈদের পোশাকের বিক্রিতে ভাটা
ঊর্ধ্বমুখী মুদ্রাস্ফীতি আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দামের মধ্যে এবারের ঈদ মৌসুমে ক্রেতারা ঈদের পোশাকের পেছনে ব্যয় কম করছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলমান অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে তাই খুচরা আর পাইকারি দুই ক্ষেত্রেই সামগ্রিকভাবে পোশাক বিক্রি গত বছরের চেয়ে কমেছে।
দেশের অন্যতম পোশাকের বাজার ইসলামপুর, আজিজ সুপার মার্কেট ও নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাবুরহাট সহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর পাইকারিতে পোশাক বিক্রি কমেছে ৩০%-৪০%; খুচরায় এ হার ২০%-৩০%।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদকে সামনে রেখে নতুন পণ্য ও প্রচারের মাধ্যমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার বহুমুখী চেষ্টা করা হলেও এ বছর পোশাকের বিক্রি ও ক্রেতা সমাগম উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
আজিজ সুপার মার্কেটের ইউনিক ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক মোঃ মিলন বলেন, "এ বছর বিক্রি খুবই হতাশাজনক। আগের চেয়ে ২০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।"
"আমরা তো পাইকারি বিক্রেতা আর আমাদের বিক্রয় শেষ হয়ে যায় ১৫ রমজানের মধ্যেই। কিন্তু এই বছর তা হয়নি।"
তবে দেশের খুচরা বিক্রেতাদের অবস্থা যে তাদের চেয়েও খারাপ সেটিও উল্লেখ করলেন তিনি।
মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে পোশাকের খুচরা দোকান স্টাইল জোনের ব্যবস্থাপক জাহিদ হাসান বলেন, "আমরা ঈদের জন্য বিশাল কালেকশান এনেছি কিন্তু ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তেমন কিছুই বিক্রি করতে পারিনি।"
দেশী দশের সেলস এক্সিকিউটিভ মহসিন পারভেজও একই সুরে কথা বললেন।
এদিকে মার্কেটগুলোতে ক্রেতার সংখ্যাও কমেছে।
ইজি ফ্যাশনের বসুন্ধরা আউটলেটের সেলস এক্সিকিউটিভ মেহেদী হাসান বলেন, 'সাধারণত ঈদের আগে এই মার্কেটে খুব ভিড় থাকে, কিন্তু এ বছর তা হয়নি।"
মৌচাকের ফরচুন মার্কেটে ব্লু-এর স্বত্বাধিকারী মোঃ আরেফিনও জানান, বাজারে ক্রেতার উপস্থিতি কমেছে।
"কী হলো বুঝতে পারছিনা। এ মার্কেট একদম খালি।"
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি কাপড়ের বাজার পুরান ঢাকার ইসলামপুর ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রোজা শুরুর ১০ থেকে ১৫ দিন আগে তাদের ভালো বিক্রি হয়েছে। কিন্তু রোজা শুরুর দিন থেকে কমতে থাকে বিক্রি।
ইসলামপুর ঘুরে দেখা গেছে দোকানগুলোতে এখনও পোশাকে ভরা রয়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, গত বছরগুলোতে ২০ রমজানের পর তাদের দোকানের পোশাক প্রায় খালি হয়ে যেত।
ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, 'ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে অনেকে পোশাক কেনাতে টাকা কম খরচ করছে। আগে তো তারা খাবার সহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করবে, তারপর পোশাক।"
নেসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, "দেখা যায়, যে বেতন পায় ২০ হাজার টাকা, তার সংসার খরচ গত বছর ৮ হাজার টাকায় হলেও এখন লাগছে ১১ হাজার টাকা। তাই যিনি ৫টি পোশাক কিনতেন, তিনি এ বছর কিনছেন ২টি। আর এটার প্রভাব পড়েছে খুচরা বিক্রিতে। খুচরা বিক্রি জমে না ওঠায় পাইকারিতে চাহিদা কমেছে।"
তিনি বলেন, যারা উচ্চবিত্ত তাদের কথা ভিন্ন কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা অনেক হিসেব করে টাকা খরচ করছে।
ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যানুসারে, ইসলামপুরে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়ে থাকে। প্রতি বছরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা সর্বশেষ ডিজাইন অনুসরণ করে বিভিন্ন ধরনের কাপড় মজুদ করেছেন।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত দেশি কাপড়ের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ এবং বিদেশি কাপড়ের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশই পূরণ করে থাকে ইসলামপুর। বিদেশি কাপড়গুলো মূলত ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড এবং জাপান থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
সাধারণত নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল ও কেরাণীগঞ্জের বিভিন্ন কারখানার কাপড় এখানে আসে। পাজামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, থ্রিপিস, প্যান্ট পিস, লুঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় বিক্রি হয় ইসলামপুরে।
ইসলামপুরে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি শো-রুম আছে। রাস্তার ধারে ভাসমান দোকানগুলো ধরা হলে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াবে।
রকি প্রিন্ট শাড়ির বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ সাহিন বলেন, "গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০%। সাধারণত পাইকারি পণ্য রমজান শুরুর ১৫ দিন আগে ও ১৫ রমজান পর্যন্ত ভালো বিক্রি হয় । রোজার আগে বিক্রি ভালো হলোও রমজানের শুরুর পর থেকে বিক্রি কমে গেছে।"
মূলত ঈদ সামনে রেখে দর্জির কাছে বানানো পোশাকের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাজার হাজার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ইসলামপুরে কাপড় কিনতে আসেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, মার্চ মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯.৩৩%, যা সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে, তারপরও পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপ সামলাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
নরসিংদী সদর উপজেলার পাইকারি কাপড়ের হাট বাবুর হাট। এ হাটে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার দোকান আছে। তাঁতসমৃদ্ধ নরসিংদী ও এর আশেপাশের বিভিন্ন জেলার উৎপাদিত কাপড় ও কাপড়জাত পণ্য বিক্রি হয় এই হাটে। রুমাল থেকে জামদানি শাড়ি পর্যন্ত সব কাপড় পাওয়া যায় এক হাটে। তাই দেশের প্রায় সব জেলার কাপড় ব্যবসায়ীরা পাইকারি কাপড় কিনতে আসেন এখানে। ঈদ উপলক্ষ্যে কাপড় কিনতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা আসছেন বাবুরহাটে।
নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মোমেন মোল্লাহ বলেন, "ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিক্রি হয় নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী বাবুরহাটে। এবার বিক্রি কমেছে প্রায় ৩০%।"
তিনি বলেন, "সাধারণত ঈদ এলে নতুন ও পুরোনো ডিজাইনের সব পোশাকই বিক্রি হয়ে যায়। তবে এবার পুরোনো ডিজাইন সহ নতুন ডিজাইনের অনেক মাল অবিক্রিত আছে।"
এদিকে গাউছিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদেরও পাইকারি বিক্রি গত বছরের চেয়ে কমেছে।
ইজি ফ্যাশনের আজিজ সুপার মার্কেট আউটলেটের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মোহম্মদ মাহবুব বলেন, এবার ঈদে পাইকারিতে তাদের পণ্য বিক্রি কমেছে ৪০%। .