রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: বেঁচে ফেরা এক তরুণী এখন শিক্ষা অর্জনের সংগ্রামে
ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১০ বছর পূর্তি হলো আজ সোমবার (২৪ এপ্রিল)। প্রতিবছরের মত এবারো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি, যাদের অবহেলায় এই দুর্ঘটনা - তাদের বিচার নিশ্চিতসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে পোশাক শিল্পের ইতিহাসে ভয়াবহতম এ শিল্প দুর্ঘটনার দিবসটি।
দুর্ঘটনার প্রতিটি বার্ষিকীতে সাধারণত রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক ও নিহতদের পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার কথাই আলোচিত হয়। তবে ভয়াবহ সেই কালো অধ্যায়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার এক ব্যতিক্রমী কাহিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে শুনিয়েছেন ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরা তরুণী বাবলী আক্তার।
বাবলীর বয়স তখন সবে ১৩ বছর। পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে ৬ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় বাবলী যোগ দিয়েছিলেন রানা প্লাজার চতুর্থ তলায় অবস্থিত ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডে।
ভবন ধসের দিনটি আজো ভুলতে পারেন না তিনি। সেদিনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, 'সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, ভবন ধসের পর চারিদিক সব অন্ধকার হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। বিকেলে যখন জ্ঞান ফেরে, নিজেকে একটি রক্তাক্ত লাশের পাশে আবিষ্কার করি। একপর্যায়ে একটি ছোট জায়গা দিয়ে বের হয়ে আসি বাইরে। পরে সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়'।
'চারিদিকে সেই লাশ, রক্ত, মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ, আর্তনাদ – এসব মনে পড়লে আজও বুকটা কেঁপে ওঠে। আর মনে করতে চাই না এসব – এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই' – গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর থেকে মুঠোফোনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর সাথে আলাপকালে বলছিলেন বাবলী আক্তার।
রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বাবলী বুকে ও পায়ে মারাত্মকভাবে আঘাত পান। এখনো প্রায়ই বুকের ব্যথা বাবলীকে প্রচণ্ড ভোগায়। তবে এই যন্ত্রণা আর দুঃসহ স্মৃতির কারাগারে বন্দি থাকতে রাজী নন বাবলী। প্রাণে বেঁচে ফেরার পর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এই তরুণী, আর সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে আবারো লেখাপড়া শুরু করেন। এবছর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা রয়েছে তার।
বাবলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, 'দিনমজুর বাবার আয়ে ৮ জনের সংসার চালানো খুব কষ্টসাধ্য ছিল। সংসারের অভাব-অনটন কিছুটা হলেও লাঘব করতে ২০১৫ সালে আবারো সাভারের রাজিফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত বিশ্বাস গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় যোগ দেই। আমি যখন শ্রমিক হিসাবে ওই কারখানায় কাজ করি, তখন অফিসিয়াল একটি পদে আমার বয়সী এক তরুণী সেই কারখানায় চাকরি করতেন। একদিন তুচ্ছ তিনি আমাকে প্রচণ্ড অপমান করেন। তার কথাতে সেদিন উপলদ্ধি করি- একই বয়সী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার কারণে আমাকে তার সামনে মাথানিচু করে থাকতে হচ্ছে। সেদিনের সেই অপমান আমি মেনে নিতে পারিনি। এরপর সিদ্ধান্ত নেই যত কষ্টই হোক – আগে লেখাপড়া করবো। স্বপ্ন আছে লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষকতা করার, চাই শিক্ষার আলো আমার মত অভাগাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে'।
'এরপর নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০১৮ সালে সাভারের একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হই। এক্ষেত্রে সব সময় আমার মায়ের সমর্থন পেয়েছি। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব এলেও আমি মত দেইনি । নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত আর অন্য কিছুতে জড়াতে চাই না' - বাবলী যোগ করেন।
তিনি বলেন, এরপর ২০২১ সালে সাভার থেকে এসএসসি পাশ করি। এরমধ্যে শুরু হয় করোনা মহামারি। সব মিলিয়ে সংসারের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে।দিনমজুর বাবার একার আয়ে আর সাভারে থাকা সম্ভব হয়নি। এসএসসি পরীক্ষার পর – আমরা স্বপরিবারে দিনাজপুরে গ্রামের বাড়ি ফিরে আসি। এখানে এসে নিজ থেকে কিছু টিউশনি জোগাড় করে দিনাজপুরের একটি সরকারি কলেজে উচ্চ-মাধ্যমিকে ভর্তি হই। এখন ২য় বর্ষ চলছে, সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবো। আমি সবার দোয়া চাই, আমি যেন আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি, সব কালো অধ্যায়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।
বাবলী আক্তারের মা রীনা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বছরখানেক আগে আমার স্বামী রিক্সা চালাতে গিয়ে মারাত্মক এক দূর্ঘটনার শিকার হন। সে সময় বাবলী সবেমাত্র ৫ম শ্রেণি পাশ করেছে। প্রচন্ড অভাবে আমার এক ছেলেকে তখন একটা চায়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেই। এক পর্যায়ে আমাদের সংসারের দুরবস্থা দেখে এক প্রতিবেশী বাবলীকে রানা প্লাজায় নিয়ে গিয়ে চাকরি দেয়। তারপর রানা প্লাজা ধসের কাহিনি তো দেশের সবাই জানে।
রীনা বেগম জানান, বাবলী চাকরি নেওয়ার পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু, সংসারের অনটনের কারণে বেশ কিছুদিন ওকে লেখাপড়া করাতে পারিনি। এক পর্যায়ে বাবলীর প্রচণ্ড ইচ্ছার কারণে অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে ২০১৮ সালে আবারো স্কুলে দেই। লেখাপড়ার খরচ চালাতে বিভিন্ন মানুষের পেয়েছি। আল্লাহর রহমতে এবার সে এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। এখনো আমাদের সংসারে প্রচণ্ড অভাব। আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন, তার একার আয়ে সংসারে খাবার যোগানোই কঠিন। তাই বাবলী টিউশনি করে ওর লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছে। লেখাপড়া শেষে ওর শিক্ষকতা করার ইচ্ছে আছে। সমাজের সকলের কাছে দোয়া চাই যেন আমার মেয়ের স্বপ্নটা পূরণ হয়।