আগামী বাজেটেও কঠোরতা অব্যাহত থাকবে
সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ বন্ধ করাসহ সরকারের অর্থ ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতাসাধন নীতি অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটের পরিচালন ব্যয় কিছুটা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কৃচ্ছ্রতা সাধন ও চলমান ডলার সংকট মোকাবেলায় সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপিদেরও বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় কমানো এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়া, গাড়ি কেনাসহ সব ধরণের অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী ব্যয় বন্ধ করা, বিলাস পণ্য আমদানি আরও কঠোর করা, নতুন ভবন নির্মাণ এবং পূর্ত কাজে ব্যয় কমানোর কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার (১০ মে) রাতে গণভবনে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার ফলে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেটের আকার কমতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থবিভাগ সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিকভাবে এর আকার অনুমান করা হয়েছিল ৭.৬০ লাখ কোটি টাকা।
জুলাই মাসে জারি হতে যাওয়া আনুষ্ঠানিক সার্কুলারগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতিফলন দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার এনইসি সভায়ও তিনি একই কথা পুনঃব্যক্ত করেছেন বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন আমদানি নিশ্চিত করার নির্দেশনাও দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
পাশাপাশি মুদ্রানীতির মাধ্যমে ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট করে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
একইসাথে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগীদের ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর বদলে আওতা বাড়িয়ে অধিক সংখ্যক মানুষকে সুবিধা দেওয়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সরকার প্রধান।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে চাহিদা কমে যাওয়ায়, ভবিষ্যতে রপ্তানি কমার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। রপ্তানি বাড়াতে নতুন বাজার খোঁজা ও বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ সহজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনা পরিস্থিতি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গত অর্থবছরসহ চলতি অর্থবছর কৃচ্ছ্রতাসাধন করছে সরকার। এতে চলতি অর্থবছর এডিপি ও পরিচালনখাতে প্রায় ৩৪,০০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে একটি ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থবিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ।
তিনি বলেন, "সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানা হলে মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে তা ভূমিকা রাখবে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাবে। ফলে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হলে প্রাক্কলন অনুযায়ী ৭.৫% জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব হবে না।"
মাহবুব আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছতা সাধন করে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু এতবছর ধরে আমদানি পণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতির মাধ্যমে এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ন্ত্রণ করা হতো। আইএমএফ'র শর্তের কারণে আগামী অর্থবছর সে সুযোগ থাকছে না।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ বা কমানোর এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ পদক্ষেপ অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করতে এবং বিল পরিশোধের চাপ কমাতে সহায়তা করবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বিগত বছরগুলোর মতো সম্প্রসারণ না করার সরকারি সিদ্ধান্তকে 'একটি ইতিবাচক উন্নয়ন' বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
তবে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের তাগিদ দেন তিনি। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটাল মেশিনারি, র ম্যাটেরিয়াল এবং ইন্টারমিডিয়েট পণ্যের আমদানি হ্রাসের পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হতে পারে।
নতুন করে ৭.৩৫ লাখ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা পাবেন
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ১.১৯ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
এবছর নতুন করে ৭.৩৫ লাখ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত রয়েছে অর্থবিভাগের।
একইসঙ্গে বয়স্ক ভাতার পরিমাণ ১০০ টাকা বাড়ানো এবং বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
"প্রধানমন্ত্রী ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর চেয়ে উপকারভোগীর আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে পরিমাণ ভাতা দেওয়া হয়, তা দিয়ে উপকারভোগীর চাহিদা মেটে না। কিন্তু সরকার থেকে ভাতা পেলে সমাজে প্রতিবন্ধী, বিধবা কিংবা বয়স্কদের মর্যাদা বাড়ে," বলেন একজন কর্মকর্তা।
প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পর বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভাতার পরিমাণ বাড়বে কি-না, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা জানান, এ সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন এখনও হয়নি।
কাটছাঁট হতে পারে বাজেটে
পরিচালন ব্যয় কমিয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারের পরিচালন ব্যয় কিভাবে আরো কমানো যায়, তা নিয়ে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে মে'র প্রথম সপ্তাহে সভা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কোন কোনখাতে বরাদ্দ কমানো সুযোগ সে বিষয়ে ব্রিফ নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর প্রাক্কলিত বাজেটের পরিচালন ব্যয়ে আরও কাঁটছাঁট করা হবে। এতে নতুন অর্থবছর্ বাজেটের আকারও কিছুটা কমতে পারে
বৃহস্পতিবার থেকেই পরিচালন ব্যয় আরও সংকোচন করার কাজ শুরু করেছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনী বছরের বাজেটে সরকার যেখানে হাত খুলে ব্যয় করতে চায়, সেখানে এবার ব্যয় সংকোচনের নির্দেশনার মূল কারণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
সংক্ষেপে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত ৭.৬০ লাখ কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়নখাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২.৬৩ লাখ কোটি, যা চলমান অর্থবছরে ছিল ২.৪৬ লাখ কোটি।
পরিচালন ব্যয়খাতে বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪.৯৬ লাখ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দের চেয়ে ৬৫,০০০ কোটি টাকা বেশি।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেটে পরিচালনখাতে বরাদ্দ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে জিডিপির ৯.৯%, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ও সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির ৯.৭%।
আগামী ১ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট তুলে ধরবেন।