‘নাদের’-এর কাছে বাংলাদেশের গল্পটা একবার বলবেন ‘সাহেব’?
'গুন্ডা' শব্দটা নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। 'দুলু গুন্ডা'র আপত্তি ছিল না। গর্ব করে বলতেন:
'ভালোবাসা আমাকে গুন্ডা বানিয়েছিল! এইটে পড়ার সময়ে মিছিলে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ছয় দফার মিছিলে যেতে খুব ভালো লাগত। কেউ মিছিল ভাঙতে আসলে আমি চলে যেতাম সামনে। দেখতে ইচ্ছে হতো কার এত বড় বুকের পাটা মুক্তিকামী মানুষের সামনে দাঁড়ায়। এরপর পত্রিকায় খবর বের হতো দুলু আর নাদের গুন্ডার কারণে পুরান ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ বানচাল হয়নি! '৬৭ থেকে '৭১ পর্যন্ত আমার নামে সাঁইত্রিশটি মামলা দেওয়া হয়! আজ আমি নায়ক হয়েছি। কিন্তু আসল নায়ক নাদেরকে কেউ মনে রাখেনি।'
লেখালেখি ও চাকরির কারণে কয়েকবার 'দুলু' সাহেবের মুখোমুখি হয়েছি। নাদের গুন্ডার স্মৃতি তার বন্ধু দুলু গুন্ডা ওরফে নায়ক আকবর হোসেন পাঠান ওরফে ফারুকের কাছ থেকেই শোনা। ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের ক্র্যাকডাউনের রাতে পুরান ঢাকার বংশালের এক বাড়ির ছাদের ওপর থেকে অন্ধকারে দেশি বন্দুক দিয়ে প্রতিরোধ করেছিল নাদের। মারা গিয়েছিল দুই পাকিস্তানি সেনা। বংশালে এরপর না ঢুকে ভোরের আজানের পর সেখানে চিরুনি অভিযান চালায় পাকিস্তানিরা। নায়ক ফারুক একসময় বলেছিলেন, 'আমি নাদেরের মতো সাহসী ছিলাম না। নদী সাঁতরে পার হয়ে কেরানিগঞ্জ যাবার চেষ্টা করি। এরপর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই।'
—আর নাদের?
'সে টাকার বিনিময়ে ওই সময় অনেককে অস্ত্র সংগ্রহ করে দিত। তার প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ছিল সংগ্রাম নামের এক পাকিস্তানি। খাজা খয়েরউদ্দীন ও শান্তি কমিটির লোকদের দেখে নেবার জন্য সে অস্ত্র সংগ্রহে নামে। সংগ্রাম তাকে পুরান ঢাকার আর্মেনিয়ান চার্চের ওখানে আসতে বলে। চার্চের ওখানে যেয়ে নাদের টের পায় পাকিস্তান মিলিটারি ও রাজাকাররা চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। দুই সহযোদ্ধা মারা গেলে আহত অবস্থায় নাদের বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে তুলে নেয় খান সেনারা। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে তাকে মেরে ফেলে। নাদের আর কখনো ফিরে আসেনি! প গানটা মনে নেই তোমার?'—বলেই চোখ মোছা শুরু করলেন'।
গানটা ছিল—রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাশে দাঁড়িয়ে/ এক মধ্যবয়সী নারী রয়েছে দু-হাত বাড়িয়ে/ খোকা ফিরবেই..
নাদের ফেরেনি। দুলু যুদ্ধ শেষে ফিরেছিলেন। এর আগেই ১৯৭০ সালে এইচ আকবরের জলছবি সিনেমার শুটিং করেছিলেন যা তিনি যুদ্ধে থাকাকালীন ১৯৭১ সনে মুক্তি পায়। স্বাধীনতার পর দুটো আলোচিত সিনেমার পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন যা তাকে নিয়ে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়। ছবি দুটোর নাম 'আলোর মিছিল' এবং 'আবার তোরা মানুষ হ'! তাকে তুমুল আলোচনায় নিয়ে আসা আরেক ছবি নারায়ণ ঘোষ মিতা-র 'লাঠিয়াল'। এই ছবিতে তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান। সাধারণ মানুষের জীবনের প্রেমবিষয়ক দুই ছবি বক্স অফিস হিট হলে ফারুক বাংলা ছবির ইতিহাসে অন্যরকম আইকন হয়ে দাঁড়ান। এমন প্রেমবিষয়ক প্রথম ছবি 'সুজনসখী' (পরিচালক আতাউর রহমান খান এবং চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আমজাদ হোসেন) আর দ্বিতীয় ছবিটার নাম 'নয়নমনি', যার পরিচালক ছিলেন আমজাদ হোসেন।
নায়ক ফারুকের 'গানভাগ্য' ছিল চোখে পড়ার মতো, যা তিনি প্রথম পান 'আলোর মিছিল' ছবিতে। ববিতার (ছবিতে নাম আলো) মৃতদেহ দুই হাতে নিয়ে আসার সময়ে ধীর লয়ে বাজতে থাকা 'এই পৃথিবীর পরে/ কত ফুল ফোটে আর ঝরে...' গানটি এখনও দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
সখী কবরীকে নিয়ে প্রেমিক সুজন ওরফে ফারুকের নৌকা বাইতে থাকা গান 'সব সখীরে পার করিতে নেব আনায় আনা/ তোমার বেলা নেব সখী তোমার কানের সোনা' আজও সমান জনপ্রিয়। জনপ্রিয় 'দিন যায় কথা থাকে' ছবির সেই চির যৌবনা গান 'সে যে কথা দিয়ে রাখলো না/ চলে যাবার আগে ভাবলো না/ সে কথা লেখা আছে বুকে/ দিন যায় কথা থাকে...'
নায়ক ফারুকের কথা বহুকাল আমাদের হৃদয়ে লেখা থাকবে। লেখা থাকবে সেই গান—'চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি', কিংবা 'নাগরদোলা' ছবির সেই জনপ্রিয় গান 'তুমি আরেকবার আসিয়া/ যাও মোরে কান্দাইয়া/ আমি মনের সুখে একবার কানতে চাই'! বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না বিবিসির এর জরিপের সেরা বিশটি গানের অন্যতম সেই গান- 'ও রে নীল দরিয়া/ আমায় দে রে দে ছাড়িয়া/ বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায় রে কান্দে রইয়া রইয়া'! কদম সারেং গানে গানে তখন ফিরছিলেন তার প্রিয়তমা কবরীর কাছে।
বাংলা ছবির ইতিহাসে বাঁকবদল করা দুই ছবির নাম 'সারেং বৌ' এবং 'গোলাপি এখন ট্রেনে'। নারী বা নায়িকাপ্রধান এই দুই ছবির নায়কও ছিলেন ফারুক। কদম সারেং কিংবা গোলাপী এখন ট্রেনের মিলন চরিত্রে তিনি ছিলেন অনবদ্য। এই দুই ছবি আর 'নয়ন মনি' ও 'সুজন সখী' সিনেমার কারণে তিনি গ্রামবাংলার সহজ-সরল নায়কের খ্যাতি পেয়ে যান। রি-মেক টাইপ ছবি হলেও 'সাহেব' ছবিতেও আলোচিত হয়েছিলেন। এই ছবিতে বক্সার ফারুক (হিন্দি ছবিতে খেলোয়াড় ছিলেন নায়ক অনিল কাপুর, এই ছবির আদলেই তৈরি হয়েছিল বাংলা 'সাহেব' ছবিটি) তার বোনের বিয়ের খরচ জোগাতে না পেরে নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দেন।
নিয়তি এই যে, ২০১০-এর পরে নায়ক ফারুক নিজেও কিডনি জটিলতায় ভুগে ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেন। রোগের এই জটিলতা থেকে তিনি আর মুক্ত হতে পারেননি। ১৯৮৭ সালে 'মিঞা ভাই' ছবি মুক্তির পর বাংলা চলচ্চিত্রে তার নাম হয়ে যায় মিঞা ভাই। ১৯৪৮-এর আগস্টে জন্ম নেয়া দুলু, ১৯৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা নায়ক ফারুক, সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান কিংবা বাংলা ছবির মিঞা ভাই মারা গেলেন ২০২৩ এর পনেরো মে।
মুক্তিযোদ্ধা এই নায়ক আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই লালন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর জেলখানার গেটে তার কান্না অনেকের মনে আছে। বাজারের পয়সা মেরে কিংবা ঈদের সেলামির টাকা জমিয়ে তার ছবিগুলো একদা দেখতে যেত মানুষ।
হয়তো বাংলা ছবির সেই দিন আর নেই। তারপরও নতুন করে যখন বাঁকবদল হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে তার চলে যাওয়াটা বেদনার! মুক্তিযোদ্ধা ফারুক, গ্রামবাংলার চিরসবুজ আর প্রতিবাদী নায়ক ফারুকের কথা এদেশের মানুষের হৃদয়ে লেখা থাকবে বহুদিন। হয়তো কেউ কেউ নতুন করে শুনবে সেই গান—'পোড়া বুকে দারুন খরা চোখের পানি চোখে নাই/ তুমি আরেকবার আসিয়া, যাও মোরে কান্দাইয়া/ আমি মনের সুখে একবার কানতে চাই!'