যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি সকলের জন্য উপকারী: এডিটরস গিল্ডের গোলটেবিলে বিশিষ্টজনেরা
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে মার্কিন সরকারের নতুন ভিসা নীতি - সরকার ও বিরোধীদলসহ সকলের জন্য উপকারী হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই অভ্যন্তরীণ চিন্তা থেকে এককভাবে বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে। সেখানে রাজনৈতিক কারণে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের জয়পরাজয়ের চাবিকাঠি নয়।
আজ শনিবার (২৭ মে) রাজধানীর বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে দেশের গণমাধ্যমগুলোর সম্পাদকদের একটি সংগঠন এডিটরস গিল্ড আয়োজিত "সতর্কতার কূটনীতি, নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি" শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন এডিটরস গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু।
এর আগে গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা দেন। তিনি জানান, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের এই নীতির আওতায় ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান - পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)- এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অভিজাত শ্রেণির বাংলাদেশীদের টার্গেট করে এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
"এর অন্যতম কারণ হলো- আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া। এই পলিসি যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে জনগণ উপকৃত হবে, বিরোধী দল উপকৃত হবে এবং সরকার একটা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে। এদিক থেকে দেখলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কনস্ট্রাকটিভ রোল (গঠনমূলক ভূমিকা)।"
নতুন এই ভিসা নীতি দ্বিপক্ষীয় নয়, অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক কারণে মার্কিন সরকার এ কাজটি করেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।
"মার্কিন সরকার সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দিন দিন শক্তিশালী হলেও কিছু বিষয়ে টানাপোড়েন বা মতপার্থক্য রয়েছে। এতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক এই বিশ্লেষক বলেন, "ভুলে গেলে চলবে না আর্থিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন বহুমাত্রিক। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন সরকার যথেষ্ট নির্ভরশীল। আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের ভাবনা একেবারেই নিজস্ব। বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, এটি তাদের কূটনৈতিক কৌশল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনোদিক থেকেই ক্ষতির কারণ নয়।"
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঘটনার পরে। নাইজেরিয়া ও উগান্ডার ক্ষেত্রে নির্বাচন হওয়ার পরে এসব দেশের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নীতি ঘোষণা করা হলো সম্ভাব্য নির্বাচনের কয়েকমাস আগে। যার অর্থ হচ্ছে এই যে নির্বাচনের আগেই যদি কোনো পক্ষ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে, তবে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থা নিতে দ্বিধান্বিত হবে না। এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি 'সিগন্যাল' যে তারা অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা সমর্থন করবে।
তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা পলিসি ঘোষণা গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে , যা আমরা দেখেছি।"
সাবেক পরারাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলেছে, এই বিষয়ে আমার দ্বিমত রয়েছে। কারণ, ২০১৩ সালেও কিন্তু এই সিটিতে বিশাল ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। তখন কিন্তু এই ভিসা নীতি ছিল না। এই ভিসা পলিসির বিষয়ে বর্তমান সরকারি ও বিরোধী দল সকলেই খুশি"।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের একটি 'মোড়লিপনার' দৃষ্টান্ত। আবার বঙ্গোপসাগরে আমাদের জলসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের গোপন উদ্দেশ্য আছে কিনা, তা কেউ স্পষ্ট করে বলছে না।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কে কি বললো, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কি চায়।
"আমরা শান্তি চাই। একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বের হয়ে সুষ্ঠ নির্বাচন চাই। বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, এরকম সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই।"
গোলটেবিল আলোচনায় আরো অংশ নেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির ও আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল।