বিদ্যুৎ বিভ্রাটে কমে গেছে উৎপাদন, লোকসানের আশঙ্কায় কারখানা মালিকরা
দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের দুটি কারখানায় দৈনিক রড উৎপাদনের সক্ষমতা ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কারখানা দুটিতে উৎপাদন কমে গেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত।
কোম্পানিটির চারটি বিলেট কারখানায় উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৬ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিলেট কারখানায়ও কমে গেছে উৎপাদন।
বিএসএআরএম'র মতো সকল রড তৈরির কারখানাসহ চট্টগ্রামে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের প্রায় ১২০০ শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন কমে গেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে গিয়ে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়।
অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা যাওয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রপাতি। এতে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে কারখানা মালিকরা। ক্ষতির মুখে পড়েছে ইমার্জেন্সি শিপমেন্টের অর্ডার থাকা পোশাক কারখানার মালিকরা।
কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, এলাকাভিত্তিক রেশনিংয়ের মধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেতো। নির্দিষ্ট সময় বিদ্যুৎ থাকলে তখন উৎপাদন চালু রেখে বাকি সময় কারখানা বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করা যেতো।
বিএসআরএম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেন গুপ্ত বলেন, "বিদ্যুৎ সংকটে আমাদের কারখানাগুলোতে সার্বিক উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানার উৎপাদন চালু রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। কম উৎপাদন এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওযায় লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা রেশনিং সিস্টেমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। এতে আমরা পরিকল্পনা করে উৎপাদন চালু রাখতে পারবো। কারণ ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা যাওয়ায় যন্ত্রপাতিও নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।"
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রপের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২১০০ টন। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন টিংকু বলেন, "লোডশেডিংয়ের সাথে বিদ্যুতের কম ভোল্টেজ বর্তমানে ইস্পাত কারখানার বড় সমস্যা। এতে উৎপাদন কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ কমে গেছে।"
৪০ থেকে ৫০% ক্যাপাসিটি নিয়ে চলছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানা
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, প্রতিদিন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ছয় থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এসময় অর্ডার কম হলেও, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
প্রতিটি কারখানাই এখন উচ্চমূল্যের এয়ার শিপমেন্টের আশঙ্কায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা সময়মতো শিপমেন্ট পাঠাতে ব্যর্থ হলে ক্রেতারা অন্য গন্তব্যে চলে যেতে পারেন।"
এই সংকট উৎপাদন দক্ষতাকে প্রভাবিত করছে, বর্জ্যের পরিমাণ বাড়াচ্ছে, যাতে নষ্ট হচ্ছে তাদের পুঁজি।
তিনি আরও বলেন, তাদের বিপুল সংখ্যক সদস্য কারখানা ৪০% থেকে ৫০% ক্যাপাসিটিতে চলছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুতের প্রকৃত অবস্থা জানতে তারা প্রতিদিন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন বলেও উল্লেখ করেন আজিম।
একটি বহুজাতিক কোম্পানির বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান এ বিষয়ে বলেন, "আমরা খুবই আশাবাদী। আমরা সরকারি আশ্বাসের উপর ভরসা রেখেই আছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সামনেই প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে এবং ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যেই সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে।"
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা কিছুটা ভাগ্যবান কারণ তাদের বেশিরভাগেরই ক্যাপাসিটি গ্যাপ প্রায় ২০-৩০%, যার ফলে লোডশেডিংয়ের সময়টায় এয়ার শিপমেন্ট এড়ানো যায়।
তবে, ইতোমধ্যেই যেসব অর্ডার আছে তার কাজ শেষ করতে তাদের অতিরিক্ত জ্বালানী বা ওভারটাইমের খরচ বহন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কিছু কারখানায় অর্ডারের কাজ শেষ করতে ২-৩ ঘণ্টা ওভারটাইম চলছে।
"যদিও এতে তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কিন্তু এটি এয়ার শিপমেন্টের খরচের তুলনায় ভাল," তিনি যোগ করেন।
বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে আমরা শিপমেন্টের সময়সীমা নিয়ে চিন্তিত। বেশিরভাগ কারখানাই ৫০% থেকে ৬০% ক্যাপাসিটিতে চলছে, যার ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।"
বিকেএমইএও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন আরও বলেন, এই খাতের বেশিরভাগ কারখানা বর্তমানে ৫০% ক্যাপাসিটিতে চলছে, কিন্তু অনেক টেক্সটাইল কারখানার উৎপাদন তাদের ক্ষমতার ৩০% পর্যন্ত কমে গেছে।
তিনি বলেন, "বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি এযাবতকালের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। এমনকি গুলশান ও বনানীর মতো এলাকাগুলোতেও তীব্র লোডশেডিং হচ্ছে।"
আলী খোকন বলেন, "বারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরও আমরা এই সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি। বর্তমানে বিদ্যুতের দাম ২০১০ সালের তুলনায় ১৬০.৪৬% বেশি।"
একটি নেতৃস্থানীয় টেক্সটাইল প্রস্তুতকারকের উদাহরণ তুলে ধরে বিটিএমএ সভাপতি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানটির মাসিক গ্যাস বিল গড়ে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা হয়েছে, যা আগে ছিল ৩৫ কোটি টাকা। "এই সেক্টর কিভাবে টিকে থাকবে?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, "আমরা প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম কিন্তু সরকার তা ৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। তারপরও গ্যাস সরবরাহের পরিস্থিতি আগের মতোই রয়েছে।"
উৎপাদন খরচ বেড়েছে
চট্টগ্রামের পোশাক কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ না থাকায় বিকল্প পদ্ধতিতে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে গিয়ে তেল খরচ আগের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে জেনারেটরও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক অটোমেটিক মেশিনগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিজিএমইএ'র ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, "বিদ্যুতের অস্বাভাবিক ঘাটতির কারণে পোশাক শিল্প কারখানায় ১০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালু রাখার কারণে ডিজেলের খরচ বেড়ে গেছে ১০ শতাংশ। এতে গার্মেন্টস মালিকরা ২০ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে বলে আসছি- বিদ্যুৎ আমাদের রেশনিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হোক। কোন সময়ে বিদ্যুৎ থাকবে না সেটি জানিয়ে দিলে তাহলে ওই সময়ে উৎপাদন চালু রাখার বিষয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো।"
চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ১৫০০-১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে ৪০০-৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে।