ইউক্রেন: দাম দেওয়ার পরও মিলছে না অস্ত্রের চালান, পশ্চিমা মিত্রদের অস্ত্রেও অসংখ্য ত্রুটি
ঠিকাদারদের কয়েকশ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার পরও সমরাস্ত্রের চালান পায়নি ইউক্রেন। আবার সরবরাহকৃত অনেক অস্ত্রের দশা এতটাই জীর্ণ যে সেগুলো কেবল খুচরা যন্ত্রাংশ হিসেবেই ব্যবহারের করতে বাধ্য হচ্ছে দেশটি।
ইউক্রেন সরকারের নথিপত্র অনুযায়ী, রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে গত বছরের শেষ নাগাদ দেশটির চুক্তিবদ্ধ সমরাস্ত্র ঠিকাদারেরা প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের চুক্তির অস্ত্র একেবারেই সরবরাহ করেনি অথবা কেবল আংশিক করেছে।
ইউক্রেনের অস্ত্র ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন, কিছু অস্ত্র শেষ পর্যন্ত সরবরাহ করেছেন ঠিকাদারেরা। অনেকে চুক্তিমতো অস্ত্র দিতে না পারায় অর্থ ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু এ বসন্তের শুরুর দিকের হিসাব পর্যন্ত, পরিশোধ করা কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র এখনো হাতে পায়নি ইউক্রেন সরকার।
আর অর্থ নিয়েও অস্ত্র সরবরাহ না করার এ তালিকায় রয়েছে দেশটির কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিও।
দেশটির একজন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভলোদোমির হাভরিলভ বলেছেন, সরকার এখন অতীতের ক্রয়ের হিসাব বিশ্লেষণ শুরু করেছে এবং প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা ঠিকাদারদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে মোট ৪০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসহায়তা দিয়েছে বা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্র দেশগুলোও ইউক্রেনকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়েছে। আর ইউক্রেনও অস্ত্র ক্রয়ের জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই এ মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে পুরোনো অস্ত্র পাঠিয়েছে যেগুলোকে ভালোভাবে মেরামত করার পরই কেবল ব্যবহার করতে পেরেছে কিয়েভ।
কিয়েভের অস্ত্রাগারের প্রায় ৩০ শতাংশ অস্ত্র সব সময় মেরামত প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধরত দেশ হিসেবে ইউক্রেনের জন্য এ হারকে উচ্চ বলে মত দিয়েছেন।
সম্প্রতি ইতালীয় সরকার ইউক্রেনকে ৩৩টি সেল্ফ-প্রপেলড হাউটজার দিয়েছে। কিন্তু মানের দিক থেকে এগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের মতো উপযোগী ছিল না। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এগুলোর একটির ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং অন্যটির ইঞ্জিন থেকে তরল কুলেন্ট চুইয়ে পড়ছে।
ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবশ্য এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছিলেন, এ যুদ্ধযানগুলো দেশটিতে কয়েক বছর আগেই ডিকমিশন করা হয়েছিল। তবে তিনি আরও জানিয়েছেন, ইউক্রেন নাকি যুদ্ধের চাহিদা সামলাতে পুরোনো ওই অস্ত্রগুলোই চেয়েছিল।
ইউক্রেন সরকারের কাগজপত্র অনুযায়ী, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আল্ট্রা ডিফেন্স কর্পোরেশন নামক একটি মার্কিন কোম্পানিকে ১৯.৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছিল ৩৩টি হাউটজার সংস্কারের জন্য। জানুয়ারি মাসে ১৩টি হাউটজার মেরামত করে ইউক্রেনে পাঠায় কোম্পানিটি, কিন্তু — সরকারি নথি অনুযায়ী — 'সেগুলো কোনো যুদ্ধে কাজে লাগানোর মতো উপযুক্ত ছিল না।'
আল্ট্রা ডিফেন্স কর্পোরেশন-এর প্রধান নির্বাহী ম্যাথু হেরিং এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'আমরা যখন সরবরাহ করেছিলাম, তখন প্রতিটা হাউটজারই কাজ করছিল।' তার অভিযোগ, হাউটজারগুলোর দায়িত্ব ইউক্রেনকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর সেগুলোর ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করেনি দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, পেন্টাগনের ইন্সপেক্টর জেনারেল বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন।
তবে মিত্রদের অস্ত্রের দুর্বলতার কথা প্রকাশ করে তাদেরকে লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাননি বলে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এসব অস্ত্রের সমস্যা নিয়ে অনেকাংশেই চেপে গিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেন তার অস্ত্রভান্ডার থেকে সোভিয়েত যুগের অনেক অস্ত্র বিক্রি করে দিয়েছিল। এরপর ২০১০-এর দশকে রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর এফ. ইয়ানুকভিচও সমরাস্ত্রের মজুত কমান।
এর ফলে রাশিয়ার আক্রমণের পরপরই অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে কিয়েভ। আর এরই সুযোগ নিতে চেষ্টা করে অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ী ও মধ্যসত্ত্বভোগী। তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র কেনার বিষয়ে প্রচুর প্রস্তাব দিতে থাকে। এ ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই নির্ভরযোগ্য ছিলেন না।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর কাছে আসা সরকারি হিসাবের একাধিক নথির তথ্য অনুযায়ী, অস্ত্রের সরবরাহ না পাওয়া ব্যয়বহুল চুক্তির অনেকগুলোই হয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি অস্ত্র কোম্পানির সঙ্গে। এ কোম্পানিগুলো সাধারণত স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে।
পশ্চিমাদের সহায়তা করা অনেক অস্ত্রের মধ্যেও খুঁত খুঁজে পেয়েছে ইউক্রেন। এসব অস্ত্রের জীর্ণদশা, সরবরাহে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ইউক্রেনের পালটা আক্রমণের পরিকল্পনাকে আরও বেশি জটিল করে তুলেছিল।
গত গ্রীষ্মে মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটকে কুয়েতের একটি ঘাঁটি থেকে ২৯টি হামভি (সাঁজোয়া জিপগাড়ি) ইউক্রেনে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ইউনিটটির প্রধান আগে বলেছিলেন, কেবল একটি হামভি বাদে বাকি সবগুলো 'যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত' ছিল।
কিন্তু পেন্টাগনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউক্রেন হামভিগুলো পাওয়ার পর প্রাথমিক পরিদর্শনে দেখা যায়, ২৬টি হামভিই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর জন্য অনুপযুক্ত।
এরপর আগস্টের শেষ দিকে ঠিকাদারি চুক্তির মাধ্যমে গাড়িগুলোর ট্রান্সমিশন, নষ্ট ব্যাটারি, জ্বালানি চোয়ানো, ভাঙা লাইট, দরজার হুড়কো ও সিটবেল্ট মেরামত করে জানানো হয়, এবার ২৯টি হামভিই ইউক্রেনের জন্য প্রস্তুত। এ কাজ যাচাই করে কুয়েতের ওই সেনা ইউনিট।
কিন্তু হামভিগুলো পোল্যান্ডের একটি ঘাঁটিতে নেওয়ার পর দেখা যায়, ২৫টি হামভিরই টায়ার পঁচে গেছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক টায়ার সংগ্রহ করে সেগুলো সারাতে আরও এক মাস লাগে।
একই ঘটনা ঘটেছে ছয়টি এম৭৭৭ হাউটজার নিয়েও। ওই হাউটজারগুলো কুয়েতের ঘাঁটিতে দীর্ঘদিন পড়ে থেকে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে একটির অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, সেটি ব্যবহার করতে গেলে কারও নিহত হওয়ার ঝুঁকিও ছিল।
রাশিয়ার আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পরে কুয়েতের ওই মার্কিন সেনা ইউনিটটির হাউটজারগুলো ইউক্রেনে পাঠানোর কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত আরও তিন মাস সময় নিয়ে মেরামত করে পোল্যান্ডের ঘাঁটিতে সেগুলোকে পাঠানো হয়।
কিন্তু কর্মকর্তারা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, ছয়টি হাউটজারই ত্রুটিপূর্ণ এবং এগুলো রণক্ষেত্রে ব্যবহারে অনুপযুক্ত। পরে পোল্যান্ডে পুনরায় সেগুলোর মেরামতের ব্যবস্থা করা হয়।
ইউক্রেন অনেক অস্ত্রের মারাত্মক অভাবে ভুগছে। আবার অনেক অস্ত্রই যেকোনো সময় বিকল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য দেশটির বিভিন্ন অস্ত্রের প্রচুর খুচরা অংশের প্রয়োজন হচ্ছে। আর তা মেটাতে বাধ্য হয়ে পশ্চিমা অনেক ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রের চালানও সাদরে গ্রহণ করছে কিয়েভ।