নাটকীয়তা, ঐশ্বর্য ও সমুদ্র: টাইটানিক যে কারণে এখনো সবাইকে প্রলুব্ধ করে
অনেকের মনেই সম্প্রতি ঘুরপাক খাচ্ছে একটি প্রশ্ন। কেন বিশ্বের ধনী মানুষেরা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ছোট আকৃতির 'পরীক্ষামূলক' সাবমেরিনে চড়ে সমুদ্রের তলদেশে যেতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছেন?
১৯১২ সালে প্রথম সমুদ্রযাত্রাতেই আটলান্টিক মহাসাগরে আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় বিশাল আকৃতির জাহাজটি। অথচ টাইটানিক কখনো ডুববে না বলে মন্তব্য করেছিলেন সমুদ্রযানটির নির্মাতারা। আমেরিকা মহাদেশে স্প্যানিশ বিজয়ের সূচনা করা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নৌবহরে থাকা নিনা, পিন্টা এবং সান্তা কিংবা ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের মধ্যে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের পূর্ব উপকূলে পা রাখা ক্যাপ্টেন কুকের এইচএমএস এন্ডেভার-এর চেয়েও টাইটানিকই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত জাহাজ।
টাইটানিকের প্রথম সমুদ্রযাত্রা এবং বিপর্যয়কর সমাপ্তি ছিল ১৯১২ সালের সবচেয়ে বড় খবরগুলোর মধ্যে একটি, এবং তখন থেকেই এটি মানুষদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করছে। বিংশ শতাব্দীতে অনেক গান ও একাধিক চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে টাইটানিকের কথা। জেমস ক্যামেরনের ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া 'টাইটানিক' দীর্ঘ সময় সর্বকালের সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র হিসেবে রাজত্ব করেছে।
অতি সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক, সেভিয়া ও হংকং-এ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের অংশ এবং অবিকলভাবে পুনঃনির্মিত জাহাজটির কক্ষগুলোর প্রদর্শনীতে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে।
ঐশ্বর্য এবং অভিবাসী
টাইটানিকের প্রতি মানুষের এত আকৃষ্ট হওয়ার এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তার ধ্বংসাবশেষ দেখতে অর্থ ব্যয় করার মূলত দুটি কারণ রয়েছে।
প্রথমটি হলো এর ঐশ্বর্য। টাইটানিক তৈরি করা প্রতিষ্ঠান হোয়াইট স্টার্ট লাইন তার বিজ্ঞাপনে জাহাজটিক সবচেয়ে বিলাসবহুল সমুদ্রযান হিসেবে প্রচার করেছিল। ধনী যাত্রীরা টাইটানিকের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং প্রশস্ত প্রথম শ্রেণির কেবিনগুলোর জন্য ১১০ বছর আগে ৮৭০ পাউন্ড পর্যন্ত ব্যয় করেছেন। তখনকার পাউন্ডের বাজারমূল্য বোঝা যাবে একটি উদাহরণে। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পদাতিক সৈন্যদের বাৎসরিক বেতন ছিল ২০ পাউন্ড।
আর টাইটানিক চলচ্চিত্র বা প্রদর্শনী জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো দর্শকরা এসবে জাহাজে ব্যবহার হওয়া দারুণ কারুকার্যের সব আসবাব, ধনী যাত্রীদের পরিধান করা জমকালো পোশাক ও অভিনব রেস্তোরাঁয় তাদের আহারের দৃশ্য উপভোগ করেন।
প্রথম শ্রেণির যাত্রীরা স্যামন, স্টেক এবং প্যাটে ডি ফোয়ে গ্রাসের মতো মুখরোচক সব খাবারে ডিনার সম্পন্ন করতেন। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান শেফরা কৌতূহলী অতিথিদের জন্য এখনো টাইটানিকের অনুরূপ খাবার তৈরি করেন।
ক্যামেরনের ছবিতে জ্যাকের (লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অভিনীত চরিত্র) মতো অনেক গরিব অভিবাসীও টাইটানিকে চড়ার সুযোগ পান। তারা জনাকীর্ণ কোয়ার্টারে বাস করে এবং সিদ্ধ গরুর মাংস এবং আলুর মতো খাবার খেয়ে দিন পার করতেন। যদি তাদের সমগোত্রীয়রাই কেবল টাইটানিকে থাকত তাহলে — বিতর্কসাপেক্ষে — জাহাজটি মানুষের স্মৃতি থেকে সরে যেত এতদিনে।
সমুদ্রের শক্তি
টাইটানিক কখনো ডুববে না বলে মন্তব্য করার বিষয়টিও এটির প্রতি আরও আকর্ষণের কারণ। জাহাজটির বিশালাকারের জন্যই এর নাম রাখা হয় টাইটানিক। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেন সমুদ্রে কোনও ক্ষতির শিকার না হয়। ইংল্যান্ড থেকে ছাড়ার পর জাহাজটি প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আর এখন এটি আটলান্টিকের নিচে অদম্য সমুদ্রের তীব্র শক্তির অনুস্মারক হিসেবে পড়ে আছে।
টাইটান সাবমেরিন ডুবে যাওয়ায় ঘটনা বিশ্বব্যাপী এত আকর্ষণ তৈরি করার পেছনেও কারণ ঠিক দুটিই। সমুদ্রযাত্রায় মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এবং সমুদ্রের কাছে সাবমেরিনের পরাজয়।
টাইটানিকের মতো টাইটানও আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কারণ এখানের আছে বিলাসিতার নমুনা। বিখ্যাত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে প্রত্যেক যাত্রী ব্যয় করেছেন আড়াই লাখ ডলার।
আর বাকিটা হলো কৌতূহলপূর্ণ রহস্য ও সমুদ্রের শক্তি। গণমাধ্যমগুলোতে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা চলছে সমুদ্র কতটা গভীর, পৃষ্ঠ থেকে কতটা নিচে টাইটান কিংবা টাইটানিক থাকতে পারে ইত্যাদি।
মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতা
টাইটান যাত্রীদের নিহত হওয়ার ঘটনার পর নিল আরগাওয়াল'স ডিপ সি ওয়েবসাইটটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ওয়েবসাইটে মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সমুদ্রতল পর্যন্ত দেখার সুযোগ পায়। বিভিন্ন সামুদ্রিক গভীরতায় কোন কোন প্রাণী বাস করে সেগুলোও দেখা যায়।
১১৪ মিটার গভীরে ঘাতক তিমি অরকা দেখতে পাওয়া যায়। স্কুবা ডাইভিং করে মানুষ সর্বোচ্চ ৩৩২ মিটার গভীরে যেতে পেরেছিল। আর প্রায় চার হাজার নিচে থাকা টাইটানিক পর্যন্ত যেতে একজনকে অনেকবার স্ক্রল করতে হয় ওয়েবসাইটটি।
অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির যুগে মানুষের সীমাবদ্ধতাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই ঘটনা। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স সরকারের সহায়তায় শক্তিশালী মার্কিন নৌবাহিনীও নিখোঁজ সাবমেরিন দ্রুততর সময়ে খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে পারেনি। যখন সাবমেরিনটি শনাক্ত করা গেছে ততক্ষণে আর কেউ বেঁচে নেই।
টাইটানের মাধ্যমে সাগর আরও একটি জলযানকে গ্রাস করেছে। সে সঙ্গে সমুদ্র বিষয়ে মানুষের জ্ঞান ও আয়ত্তের সীমাও মনে করিয়ে দিচ্ছে।