চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি থেকে আদায় কমেছে ১,৯৬৪ কোটি টাকা
দেশের ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক পরিমাণে বাড়লেও খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে আগের ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী এমন তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা অথচ এই সময়ে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ থেকে আদায় করেছে ৩,৩১৪ কোটি টাকা।
গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে ১৩,৭৪০ কোটি টাকা; যদিও ওই সময়ে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ থেকে আদায় করেছে ৫,২৭৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন বিবিধ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, যেমন রপ্তানিকারকদের শিপমেন্টে বিলম্ব, ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল, পেমেন্টে বিলম্ব এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মেয়াদী ঋণ পরিশোধের জন্য বিশেষ ছাড় না পাওয়া।
তারা আরও বলেন, সাধারণত খেলাপি ঋণ থেকে যে আদায়টা হচ্ছে তা নির্দিষ্ট কোন প্রান্তিকের নয়, এটা এক-দুই বছর আগের খেলাপি ঋণ হতে আদায় হতে পারে। এছাড়া ডলার সংকটের মধ্যে ব্যবসায়িক অবস্থার অবনতি ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় যথাযথ প্রফিট করতে পারছেন না, যার কারণে ঋণ আদায়ের পরিমাণ কমেছে।
মার্চ মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৩১,৬২০ টাকা, যা মোট আউটস্ট্যান্ডিং বা বকেয়া ঋণের ৮.৮০%।
অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১,২০,৬৫৬ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়ার ৮.১৬%।
গত তিন বছর যাবৎ গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে নানা ধরণের সুবিধা পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০২০-২১ সালে কোভিডের কারণে ছাড় ছিল। ২০২২ এর শুরুতে ছাড় তুলে নিলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এ বছরও ঋণ পরিশোধে ছাড় পায় গ্রাহকেরা। এ বছরের শুরু থেকে ঋণ পরিশোধের শিথিলতা তুলে ফেললেও তার উপর স্থির থাকতে পারেননি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদে চাহিদা ঋণ গ্রহণকারীদের জন্য সম্প্রতি ঋণ পরিশোধ শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অশ্রেণিকৃত ঋণে (আনক্লাসিফায়েড লোন) গ্রাহকদেরকে ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের জন্য প্রদেয় কিস্তির অর্ধেক পরিশোধের অনুমতি দেওয়া হবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রপ্তানিকারকরা শিপমেন্ট বিলম্ব, অর্ডার বাতিল এবং ক্রেতাদের দ্বারা বিলম্বিত অর্থ প্রদানের সম্মুখীন হওয়ায় ব্যাংকগুলো স্ট্রেসড সম্পদ বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে। একইসঙ্গে অনেক খেলাপি গ্রাহক তাদের ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না।"
মাহবুবুর বলেন, "এছাড়াও টাকার উচ্চ অবমূল্যায়ন, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি, গ্যাসের নিম্নচাপ এবং আমদানি সীমাবদ্ধতা, শিল্প উৎপাদনে ধীরগতি এবং ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিষেবা ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ব্যাংকগুলোকে বিপুল পরিমাণে ফোর্সড ঋণ তৈরি করতে হচ্ছে।"
আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় আদায় কম হওয়ার কারণ হলো- বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ শিথিল নীতি। ফলে দেখাচ্ছে খেলাপি বাড়ছে, আদায় কম হচ্ছে।"
"কিছু ব্যবসায়ী প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য সার্কুলার ঠিক আছে। অন্যদিকে কিছু ব্যবসায়ী এটার সুযোগ নিয়ে টাকা পরিশোধ করছে না। এতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা আসছে না এবং ব্যাংক নতুন করে লোন তৈরি করতে পারছে না।"
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলো চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে তাদের খেলাপি ঋণের ৩,৩৭৬ কোটি টাকা পুনঃনির্ধারণ (রিশিডিউল) করেছে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৮১% কম।
২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে রিশিডিউলড লোনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭,৭৬৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানান, এই বছরের মার্চ প্রান্তিকের রিশিডিউলড লোন আসলে ব্যাংকিং খাতের স্বাভাবিক পরিস্থিতিই ফুটিয়ে তোলে। তবে ডিসেম্বর প্রান্তিকের অস্বাভাবিক উচ্চ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বড় গ্রাহকদের খেলাপি ঋণের রিশিডিউলিং-কে দায়ী করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বা খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭,৯৫৮ কোটিতে, যা মোট ঋণের ১৯.৮৭%; গত বছরের ডিসেম্বরে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৬,৪৬০ কোটি টাকা।
এছাড়া চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নন-পারফর্মিং লোনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫,৮৮৮ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৫.৯৬%।