চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ, পানিবন্দী ৫ লাখ মানুষ
ছয়দিনের টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের বন্যা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদীর পানি এখনো বিপদ সীমার উপরে রয়েছে। পানিবন্দী এসব এলাকার মানুষ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও বান্দরবান মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকা পানির নিচে। ফলে বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তিন দিন ধরে বিদ্যুৎহীন রয়েছে তিন উপজেলা। সুপেয় পানি ও শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে বন্যা কবলিত এলাকায়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানান, সাতকানিয়া লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারিসহ ১৫ উপজেলা এখন প্লাবিত। এরমধ্যে সাতকানিয়ার ১৬টি ইউনিয়নের সব গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। উপজেলাগুলোতে এই মুহুর্তে প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী।
পানিতে ডুবে ও পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে এই পর্য়ন্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নৌকা ডুবিতে গতকাল বিকাল থেকে সাতকানিয়ায় তিন শিশুসহ ৪ জন নিখোঁজ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলেজ এলাকা থেকে কেরানিহাট পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানযটের সৃষ্টি হয়েছে। হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক।
১৫ টন চাল নিয়ে সিলেট থেকে উখিয়া যাচ্ছিলেন ট্রাক চালক জসীমউদ্দীন। তিনি ৩২ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে মহাসড়কে আটকে আছেন। চট্টগ্রাম থেকে মগনামা ঘাট এলাকায় সিমেন্ট নিয়ে যাওয়ার পথে ওই গাড়ির চালক গতকাল রাত সাড়ে তিনটা থেকে মহাসড়কে আটকে আছেন।
চন্দনাইশের কসাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা রোজিনা বেগমের গত সোমবার কিডনি রোগের ডায়ালাইসিস করার তারিখ থাকলেও জলাবদ্ধতার কারণে তাকে চমেক হাসপাতালে ডায়ালিসিসের জন্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কাল তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
মহাসড়কের পাশে দোহাজারী উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়, শত শত পরিবার পানিবন্দী। এখানকার বাসিন্দারা সুপেয় পানি পাচ্ছে না। বিশেষ করে চন্দনাইশ উপজেলার হাসিমপুর, বটতল,কসাই পারাসহ আশপাশের প্রায় দশটি গ্রাম কোমর থেকে গলা পরিমান পানিতে ডুবে আছে।
যাদের ঘরবাড়ি মহাসড়কের কাছে তাদের অনেকেই সড়কে আশপাশের দোকান এবং ভবনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। মহাসড়ক থেকে দুরের ঘরবাড়িতে অবস্থান করা লোকজন বের হয়ে আসার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। অনেকেই ত্রাণ নিয়ে সড়কের পাশে অবস্থান করলেও তারা নৌযানের অভাবে ত্রাণ নিয়ে দুর্গত গ্রামগুলাতে পৌঁছাতে পারছে না।
সবেচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে সাতকানিয়া উপজেলার সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী এলাকা চরতি, আমিলাইশ, নলুয়া ইউনিয়নের কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো। কারন এসব এলাকায় প্রতিটি বাড়িতেই একাধিক গরু রয়েছে। পানি উঠার পরে তারা আশপাশের এলাকায় উচু বাড়িতে আশ্রয় নিলেও গরু গুলো সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বসত ঘরের চাল ছুঁই ছুঁই পানি উঠে গেলেও অনেকেই জীবনের ঝুকি নিয়ে নিজ বাড়িতে থেকে গেছেন।
সাতকানিয়ার ১০ নং কেউচিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ পাকা বাড়ি একতলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। ডুবে আছে রাস্তার আশপাশের কমিউনিটি সেন্টার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কেউচিয়া এলাকায় ৩০ টির বেশি ব্রিকফিল্ড পানিতে তলিয়ে আছে।
সাতকানিয়া কেরানিহাটে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাস্তার আশপাশে যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভবন আছে প্রায় সবগুলোরই হাঁটু পরিমান পানিতে ডুবে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে দোকানের মালামাল। অপরদিকে চট্টগ্রাম থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় সব জিনিসের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
১০ নম্বর কেউচিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, তার পরিবার গত তিনদিন ধরে ঘরবন্দী অবস্থায় আছেন। ঘরে খাবার পানি না থাকায় কোমর সমান পানি মাড়িয়ে কেরানিহাট বাজারে এসেছিলেন বোতলজাত পানির জন্য। এখান তাকে দুই লিটার পানি ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তিনি বাধ্য হয়ে বাড়ির জন্য ছয়টি দুই লিটারের বোতলজাত পানি সংগ্রহ করেছেন। তিনি আরো বলেন,সরকারি তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কোন সহায়তা সাতকানিয়ায় এসে পৌঁছায়নি।
সাতকানিয়ার স্থানীয় সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম বাবর টিবিএসকে বলেন, এই মুহূর্তে সাতকানিয়া পৌর সদর এলাকা এবং আশপাশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে। সরকারি কোনো সহায়তা এসব মানুষের কাছে পৌছায়নি। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বন্যা কবলিত এই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
ছিপাতলী এ্যান আই চৌধুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর শিক্ষক চিং ওয়াই মারমা টিবিএসকে বলেন তার স্কুল গত চার দিন ধরে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ আছে। পরিবার থাকে বান্দরবান সদরে। সেখানে পানি প্রবেশ করেছে। স্ত্রী, মা ও সন্তানেরা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় দিন যাপন করছেন। কিন্তু বান্দরবান মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তিনি বাড়ি যেতে পারছেন না।
সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও সৌদি প্রবাসী জামাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, তার এলাকার নব্বই শতাংশ বাড়ি এই মুহূর্তে পানিতে আছে। অধিকাংশ পরিবার এই মুহূর্তে নলুয়া ছেড়ে সাতকানিয়া সদরের আশপাশের বাড়ি ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল খাবার পানি। সাবমারসিবল পাম্পগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় এবং বিশেষ করে পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ গুলো পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে এলাকায় পানীয় জলের বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়েও খাবার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মতে গত ৪০ বছরে বৃষ্টিতে এমন পানি বা জলাবদ্ধতার ঘটনা ঘটেনি।
কেরানিহাট এলাকার ন্যাশনাল টাওয়ারের বেকারি শপ জেসি ফুড এর দোকান মালিক জাহিদুল ইসলাম টিবিএস কে বলেন, গত দুদিন মার্কেটের নিচ তলাটি পানিতে তলিয়ে ছিল। আজ পানি কমায় তিনি বিক্রি শুরু করেছেন। সকাল থেকে মাত্র তিন ঘন্টায় তার প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ মালামাল বিক্রি হয়ে গেছে। এমনকি যেসব দোকান পাট এখনো তলিয়ে আছে। তাদের মালামালও এই দোকানটিতে নিয়ে এসে বিক্রি করছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বুধবার সকাল থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত কমে এসেছে। আগামী শুক্রবার পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম।