অতিরিক্ত দায়ের বোঝায় থাকা রুগ্ন-অচল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে আরজেএসসি
২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে নিবন্ধিত দেশের ৩,১০০টি রুগ্ন ও অচল কোম্পানির মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা দায় রয়েছে।
রুগ্ন ও অচল কোম্পানির চিহ্নিত করে এই তালিকা তৈরি করেছে যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে সংস্থাটি।
এই কোম্পানিগুলোর মূলধন সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা, যা তাদের কাছে ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির পাওনা টাকার অর্ধেক মাত্র।
আরজেএসসি'র রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত সচিব) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রায় এক বছর কাজ করে এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে।
"অনেকগুলো রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরজেএসসি-তে অভিযোগ রয়েছে। সেই সূত্র ধরেই আমরা একটি উদ্যোগ নেই এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার। প্রাথমিকভাবে এই ৩১০০ কোম্পানি চিহ্নিত করে তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে," বলেন তিনি।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব-উল আলম টিবিএসকে বলেন, "এসব রুগ্ন ও অচল কোম্পানি বিভিন্ন উপায়ে অর্থনীতিতে নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। এসব কোম্পানির কারণে সরকারি রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নন-পারফর্মিং ঋণ বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, উৎপাদনের ক্ষতি হচ্ছে।"
কোম্পানি রুগ্ন থাকার উপকারিতা!
আরজেএসসি জানিয়েছে, ৩১০০ কোম্পানির মধ্যে প্রায় ২১৫০টি কোম্পানিকে রুগ্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাকি ৯৫০টি অচল কোম্পানি। এসব কোম্পানির মূলধন ছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। আর তাদের দায় রয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
আরজেএসসি'র এক কর্মকর্তা জানান, তদন্তে দেখা গেছে, একটি কোম্পানির এমডি বা চেয়ারম্যান বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তার নিকটাত্মীয় বা অন্য কারো নামে ভিন্ন কোম্পানি খুলে অন্য ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদেরও যথাযথ ব্যবস্থার অধীনে আনা হবে।
"আবার সরকারের কাছ থেকে, ব্যাংকের কাছ থেকে বা শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে অনেকে তাদের কোম্পানিকে এরকম রুগ্ন বা অচল দেখাচ্ছে। এরকম কোম্পানিগুলোকে অবসায়ন করার সুপারিশ করা হবে।"
আরকেএম ফ্যাশন লিমিটেডের কথাই ধরা যাক। ২০১২ সালে নিবন্ধিত এই কোম্পানিটি তৈরি পোশাক আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবছর আরজেএসসিতে অডিট রিপোর্ট ও রিটার্ন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। বর্তমানে তারা ১১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মামলা রয়েছে কোম্পানির নামে।
এছাড়াও, একজন শেয়ারহোল্ডার তার শেয়ার ফেরত পেতে কোম্পানির বিরুদ্ধে আরজেএসসিতে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ কারণে কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে আরজেএসসি।
ইন্টারবিডি লিমিটেডের কথাও উল্লেখ করেছে আরজেএসসি। ২০১১ সালে রাসায়নিক আমদানিকারক এবং বিপণনকারী কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় তারা। কোম্পানিটি ২০১৯ সাল থেকে ব্যবসায় লোকসানের মুখোমুখি হয়। এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ৮০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি রয়েছে।
কোম্পানিটির মূলধন ছিল মাত্র ৩০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আদায়ে চারটি ব্যাংক এ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার নথি দেখে আরজেএসসি জানতে পারে, এটি একটি রুগ্ন কোম্পানি।
এই কোম্পানির তদন্তে নিয়োজিত আরজেএসসি'র এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংক ঋণ ছাড়াও কোম্পানিটির কাছে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীর প্রায় ৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে হাইকোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করা হবে কোম্পানি অবসায়নের জন্য। আরজেএসসি তারপর এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার জন্য সমস্ত পদক্ষেপ নেবে।"
আরজেএসসির অপর একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ইন্টারবিডি লিমিটেডের এমডি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ও বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তার স্ত্রীর নামে আরেকটি ব্যবসা শুরু করেন।
তবে ইন্টারবিডি'র এমডি এ কে এম আলি রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, "এই কোম্পানি আরজেএসসি'র রুগ্ন তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর কারণে হলো, ২০১৪ সালে প্রায় ৪০ কোটি টাকার একটি শিপমেন্ট খালাসে সমস্যা হলে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হই। পরবর্তিতে ক্ষতি পোষানোর আশায় ব্যবসা চালিয়ে গেলে আমরা আরো ক্ষতির মুখে পড়ি। এখন ব্যাংক, বিভিন্ন ব্যক্তি মামলা করেছে আমাদের বিরুদ্ধে, সেগুলো আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করবো।"
কিন্তু আরজেএসসি সুত্র বলছে, তদন্ত সম্পন্ন করে এই কোম্পানি অবসায়নের মাধ্যমে পাওনাদারদের পাওনা আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে।
এফবিসিসিআই'র প্রেসিডেন্ট মো. জসীম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ অচল ও রুগ্ন কোম্পানির কারণে আমাদের অর্থনীতিতে একটি নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ছে। এছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠান নানাভাবে বিভিন্ন অনিয়ম ও বেআইনি কাজের সাথেও জড়িত আছে। এসব বন্ধ করলে ব্যবসার পরিবেশ ও অর্থনীতি অনেকটাই ভালো হবে।"
রুগ্ন কোম্পানি বলতে মূলত বোঝায়, যেসব কোম্পানি পাঁচ বছরের কম সময় ধরে বিদ্যমান ছিল কিন্তু কোনো আর্থিক বছরের শেষে তার সম্পূর্ণ নেট মূল্যের সমান বা তারচেয়ে বেশি পুঞ্জীভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আর অচল কোম্পানি বলতে বোঝায়, যেসব কোম্পানির নিবন্ধন রয়েছে কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কোনো কার্যক্রম নেই।
এরকম কোম্পানির বিষয়ে তদন্তকারী আরজেএসসির একজন কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে যেসব কোম্পানি রুগ্ন ও অচল মনে হয়েছে সংস্থার কাছে, সেগুলোরই তদন্ত করা হচ্ছে। এসব কোম্পানি কেন রুগ্ন হয়েছে বা অচল হয়েছে তদন্তে সেসব বিষয়ে গুরুত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, "যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে রুগ্ন বা অচল দেখায় তাদের কোম্পানিকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।"
আরজেএসসি'র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "তদন্ত সম্পন্ন করে এসব কোম্পানির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইন অনুযায়ী হাইকোর্টে আবেদন করা হবে। যেসব কোম্পানি রিভাইব করা সম্ভব নয় আদালত সেগুলো অবসায়ন করার নির্দেশ দেবে।"
আইনগত জটিলতা
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব-উল আলম বলেন, বাংলাদেশের কোম্পানি আইন অনুযায়ী এরকম রুগ্ন ও অচল কোম্পানি সরাসরি বন্ধ করতে পারে না রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান আরজেএসসি। যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার অবসায়নের আবেদন করে, সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট লিকুইডেশনের পদক্ষেপ নিতে পারে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে আরজেএসসি এসব কোম্পানির প্রতিবছরের প্রতিবেদন না পেলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নিতে পারে। এরপর তদন্ত শেষ করে হাইকোর্টে আবেদন করলে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে আরজেএসসি।
তিনি বলেন, "আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রুগ্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্য সিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানিস অ্যাক্ট অব ১৯৮৫ প্রণয়ন করে। ২০১৬ সালে সেটি সংশোধন করে আপডেট করা হয়। এছাড়াও অচল কোম্পানি বন্ধ বা অবসায়ন করতে সে দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এখতিয়ার দেওয়া আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কিছু নেই।"
আরজেএসসি'র রেজিস্ট্রার শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, এরকম রুগ্ন ও অচল কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতের মিনিস্ট্রি অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্সের অধীনে কোম্পানি নিবন্ধক সংস্থাকে সরাসরি আইনি এখতিয়ার দেওয়া আছে।
তিনি বলেন, "আরজেএসসি এরকম এখতিয়ার চেয়ে প্রায় ছয় মাস আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, এই এখতিয়ার থাকলে আরজেএসসি দেশের রুগ্ন, অচল ও গোস্ট কম্পানির বিরুদ্ধে সহজে উদ্যোগ নিতে পারবে। এটা করা সম্ভব হলে দেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক সেক্টরে আরো শৃঙ্খলা আসবে।"