ঢাকায় খেলার মাঠের ঘাটতি রয়েছে ৭৯৫টি: সমীক্ষা
নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, ঢাকা মহাগরীতে ৭৯৫টি এবং চট্টগ্রামে ৫৪১টি খেলার মাঠের ঘাটতি রয়েছে বলে উঠে এসেছে সম্প্রতি এক গবেষণায়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)-এর সাম্প্রতিক ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নগর এলাকার জনসংখ্যার আকার ও ধরন অনুযায়ী নগর এলাকায় খেলার মাঠের তীব্র সংকটের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে খেলার মাঠ আছে ২৩৫টি। নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, ঢাকা মহাগরীতে আরও ৭৯৫টি খেলার মাঠ প্রয়োজন। এছাড়া চট্টগ্রামে ৫৪১টি, রাজশাহীতে ৩৭টি, খুলনাতে ৬৫টি, সিলেটে ৪০টি ও বরিশালে ৪৫টি খেলার মাঠের ঘাটতি রয়েছে।
বুধবার (৩০ আগস্ট) 'ঢাকা মহানগরীর খেলার মাঠ-পার্ক-গণপরিসর সুবিধাদির এলাকাভিত্তিক সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে টেকসই পরিকল্পনা' শীর্ষক নগর সংলাপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
সংলাপের আয়োজন করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি); সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ এবং নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম বাংলাদেশ।
মূল প্রবন্ধে পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, "পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় প্রতি তিন থেকে ৫ হাজার মানুষের জন্য একটি করে শিশুদের (৩-৬ বছর) খেলার মাঠ (প্রে লট), কিশোরদের জন্য (৭-১৫ বছর) প্লে-গ্রাউন্ড ও বড়দের জন্য (১৫ ঊর্ধ্ব বয়সী) প্লে-ফিল্ডের সুবিধা থাকতে হয়। পরিকল্পনার সূচক সম্পর্কিত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টাইম সেন্ডার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য ০.৫১ একর আয়তনের প্লে লট, ১.৫ - ৩ একরের প্লে-গ্রাউন্ড, ১.৫ - ১৫ একর আয়তনের প্রে-ফিল্ড থাকা প্রয়োজন।
শিশু-কিশোরদের জন্য তিন ধরনের খেলার মাঠের পরিকল্পনা করার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন বয়স শ্রেণির জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর ডিসিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) তথ্য দিয়ে বলেন, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিদিন ন্যূনতম ১ ঘন্টা করে খেলাধুলা ও শারীরিক সক্রিয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন।
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ন্যূনতম ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা (খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি) থাকা উচিত। মাঠের ঘাটতির ফলে এ সকল নগর এলাকার অধিকাংশ শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, খেলার মাঠের মতই নগর এলাকায় তিন ধরনের পার্কের পরিকল্পনা করতে হয়। যেমন- নেইবারহুড পার্ক, কমিউনিটি লেভেল পার্ক, আরবান বা সিটি পার্ক।
"আমাদের দেশের নগর পরিকল্পনায় এই ধরনের শ্রেণিভিত্তিক পার্ক পরিকল্পনা দেখা যায় না। ফলে বিশাল জনসংখ্যার এই ঢাকা মহানগরীতে বিভিন্ন শ্রেণির পার্ক ও গণপরিসরের তীব্র সংকট আছে," বলেন তিনি।
আইপিডি'র উপদেষ্টা অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, "আমাদের যে উন্নয়ন পরিকল্পনা দর্শন, সেখানে আদৌ গণপরিসরের বিষয় চিন্তা করা হয় না। আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকাতেই গণপরিসরের বিষয় নেই। আমাদের মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধির জন্য দরকার খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন দর্শনে সেটি নেই।"
ঢাকা শহরের বিদ্যমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১০) অনুসারে, প্রতি সাড়ে ১২ হাজার জনসংখ্যার জন্য ২ থেকে ৩টি খেলার মাঠ দরকার, যার প্রতিটির আয়তন হবে ন্যূনতম এক একর; সেই হিসেবে ঢাকা শহরে খেলার সুবিধা নিশ্চিত করতে হাজার খানেক খেলার মাঠ প্রয়োজন।
অথচ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর ২০১৯ সালের গবেষণায় তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে খেলার মাঠ আছে ২৩৫টি, যার অধিকাংশই (১৪১) প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ যেখানে এলাকাবাসী তথা সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার নেই।
বিদ্যমান বেশ কিছু খেলার মাঠ বিভিন্ন ক্লাবের নামে দখল হয়ে আছে, যেখানে পাড়া-মহল্লার শিশু-কিশোরদের অবাধ প্রবেশাধিকার নেই, অনেক ক্ষেত্রেই খেলার কোনো সুযোগ নেই। অনেক খেলার মাঠ আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়ার ফলে সেখানে খেলাধুলার আর সুযোগ থাকেনা।
আইপিডি প্ল্যানারের ডিরেক্টর মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, "যদি স্কুলে খেলার মাঠ না থাকে তাহলে সেই স্কুলের অনুমোদনই দেওয়া উচিত না। এছাড়া যখন স্কুল বন্ধ থাকবে তখনও যাতে খেলার মাঠ খোলা থাকে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।"
সেভ দ্য চিন্ড্রেনের ডিরেক্টর হিউম্যানিটারিয়ান মো. মোসতাক হোসেন বলেন, "মাঠে খেলতে যাওয়ার কারণে সামাজিকীকরণের বৃদ্ধি ঘটে। শিশুদের পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু মাঠের অভাবে যে সম্পর্ক এখন গড়ে ওঠে না বললেই চলে।"
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সকলের জন্য প্রবেশাধিকার আছে এমন মাঠের সংখ্যা মাত্র ৪২টি এবং বিআইপি'র গবেষণা অনুযায়ী ঢাকা শহরের মাত্র ১৬ ভাগ এলাকার মানুষ খেলার মাঠের পরিসেবার মধ্যে বসবাস করেন; অবশিষ্ট ৮৪ ভাগ এলাকার মানুষ খেলার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ওয়ার্ড রয়েছে ১২৯টি। এরমধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই বলে উল্লেখ রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ)।
আইপিডি'র উপদেষ্টা অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, "প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলরগন যদি পরিকল্পনা করে ৫ বছরে একটি পার্ক/খেলার মাঠ তৈরি করবে তাহলে ৫ বছরে ১২৯ টি নতুন পার্ক/খেলার মাঠ গড়ে তোলা সম্ভব।"