বনানীতে ঢাকা উত্তরের খেলার মাঠ: নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য একটি গণপরিসর?
রাজধানীর বনানীর শহীদ যায়ান চৌধুরী খেলার মাঠটিতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে ব্যানারে বড় করে লেখা সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - 'এই ক্রিকেট মাঠে ফুটবল খেলা ও ফুটবল নিয়ে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ'।
আবার এই মাঠে সবার জন্যও ক্রিকেট খেলার সুযোগ নেই। বনানী আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী শিশু-কিশোরদের জন্য দিনের নির্দিষ্ট ৫ ঘন্টা সময় মাঠে খেলাধুলার সুযোগ রয়েছে। আবার বর্ষাকালে সেটিরও সুযোগ থাকে না। নির্দিষ্ট সময় মেনে প্রবেশ করতে হয় মাঠে; হাঁটার জন্যও রয়েছে নির্দিষ্ট সময় এবং পরিধান করতে হয় নির্দিষ্ট পোশাক।
বনানীর এই মাঠ ও মাঠের পাশের হাঁটার পথ ব্যবহারে দেওয়া আছে ১৫টির মতো নির্দেশাবলী। হাঁটার পথ ব্যবহার করা যায় সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। খেলার মাঠে খেলার সুযোগ আছে মাত্র ৫ ঘন্টা; সকাল ১০টা থেকে ১টা এবং বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত।
মাঠ ব্যবহারের নির্দেশাবলীর মধ্যে রয়েছে, মাঠটি শুধুমাত্র বনানী আবাসিক এলাকার অধিবাসী শিশু-কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত। বৃষ্টির সময় এবং বৃষ্টির পরে ভেজা নরম, কর্দমাক্ত মাঠে কোনো প্রকারের খেলাধুলা ও যেকোনো কর্মকাণ্ড করা যাবে না; কারণ এতে করে মাঠের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
মাঠে প্রবেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যায়াম ও খেলাধুলার উপযোগী পোশাক ও জুতা পরিধান করতে হবে। খালি পায়ে, লুঙ্গী পরে মাঠে প্রবেশ বা অবস্থান কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যদিও নগর পরিকল্পনাবিদরা একটি পাবলিক স্পেস বা গণপরিসরে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণকারী বহুবিধ এসব নিয়মাবলীর প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করেছেন।
তারা বলছেন, জনগণের খেলার মাঠ এভাবে শর্ত দিয়ে এতো দীর্ঘ সময় বন্ধ রাখতে পারে না। কোনো এলাকার একটি খেলার মাঠ নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর জন্য নয়। সবার সমান অধিকার রয়েছে সেবা পাওয়ার।
এদিকে মাঠ ব্যবস্থাপনা কমিটি বলছে, মাঠটি ক্রিকেটের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে এবং দামী ঘাস যাতে নষ্ট হয়ে না যায়, এজন্য ক্রিকেট ব্যতীত অন্য খেলার সুযোগ দেওয়া হয় না। মাঠ পরিচর্যা এবং এলাকাবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে মাঠটি নির্দিষ্ট সময়ে খোলা রাখা হয়।
২০২১ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উদ্বোধন করা মাঠটি সম্প্রতি আধুনিকায়ন করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, উত্তরের মাঠগুলো পরিচালনার জন্য নীতিমালা করা হচ্ছে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে পরিচালনার জন্য। তখন আর এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) মাঠটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিকাল ৪টা পর্যন্ত তালাবদ্ধ থাকে মাঠে প্রবেশের একটি প্রধান গেইট ও একটি পকেট গেইট।
বিকালে মাঠের গেইট খুলে দেওয়া হলেও খুব বেশি শিশুদের দেখা যায়নি মাঠে খেলাধুলা করতে। মাঠে বসে কয়েকজন তরুণীকে গল্প করতে, নেটে ক্রিকেট প্রাক্টিসের জায়গায় কয়েকজন তরুণকে প্রাক্টিস করতে এবং কয়েকজনকে হাঁটার পথে হাঁটতে দেখা যায়।
তবে সকল শিশু কিংবা যুবকদের জন্য নেটে প্রাক্টিস করার সুযোগ নেই। নেটে ক্রিকেটের প্রাক্টিসে প্রতি ঘন্টায় ১,০০০ টাকা গুনতে হয় বলে অভিযোগ করেন কয়েকজন।
মিরপুর ১৪ থেকে এই মাঠের নেটে ক্রিকেট প্রাক্টিস করতে মাঝে মাঝে আসেন শাওন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা মাঝে মাঝে গ্রুপ করে নেটে প্রাক্টিস করতে আসি। ১ ঘন্টা প্রাক্টিস করলে আমাদের ১,০০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া, বড় মাঠে কোনো ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে একটি ফি দিয়ে ক্রিকেট পিচ ব্যবহার করতে হয়।"
মাঠের বাইরের দিকের ফুটপাতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রিকশা চালক ইয়াকুব আলী। টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমাদের মতো গরীবের কি এ মাঠের মধ্যে গিয়ে বসার সুযোগ আছে? গেইটে গেলেই দারোয়ান তাড়িয়ে দেয়। লুঙ্গি পরে নাকি মাঠের মধ্যে প্রবেশ করা যায় না।"
"মাঠের চারিদিকে খাঁচা দেওয়ার আগেই ভালো ছিল। সারাদিনই শিশু, যুবকরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলতো। আমরাও গিয়ে গাছতলাতে বসতে পারতাম। এখন মাঠের উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু খেলাধুলা নেই," বলেন তিনি।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন এ মাঠটিকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ব্যবহারের জন্য দিয়েছে, যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে সমতা, সম-অধিকারের বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
"খেলার মাঠ, পার্ক, গণপরিসর সিটি কর্পোরেশনের হলে তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও সিটি কর্পোরেশনকেই নিতে হবে। আর খেলার মাঠে এমন কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিং অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে জনগণের মাঠ তালাবদ্ধ থাকবে কেন?," যোগ করেন তিনি।
এ মাঠটির দায়িত্বে থাকা একজন কমিউনিটি মেম্বার শেখ আরিফ টিবিএসকে বলেন, বনানীর ১ নং রোডের আই ব্লকের প্রায় ৩০ জন মেম্বার চাঁদা দিয়ে মাঠের পরিচর্যা করেন।
মাঠের পেছনে প্রতিমাসে অন্তত ১ লাখ টাকা খরচ হয়, যার পুরোটাই কমিউনিটির লোকজন বহন করে জানান তিনি।
এছাড়া, মাঠ উন্মুক্ত রাখলে সেখানে মাদকসেবী এবং অনৈতিক কাজের আড্ডা বসে। "যদি কেউ বলে যে মাঠে খেলতে দেয় না, তারা অধিকাংশই কড়াইল বস্তির ছেলেপেলে," উল্লেখ করেন শেখ আরিফ।
২০২১ সালের ৬ মার্চ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি যায়ান চৌধুরীর নামে এ মাঠটি উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
প্রায় সোয়া পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে মাঠটির উন্নয়ন কাজ করে ঢাকা উত্তর সিটি। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মাঠটিতে উন্নতমানের ম্যাটেরিয়াস ও টেকনোলজি দ্বারা খেলার মাঠ ও ক্রিকেট পিচ নির্মাণ, ইন্টার্নাল ও এক্সটার্নাল ওয়াকওয়ে নির্মাণ, শিশুদের জন্য আলাদা প্লেইং জোন, পাবলিক টয়লেট, আলাদা চেঞ্জিং রুম, সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট বেঞ্চ, ক্রিকেট নেট প্র্যাকটিস ব্যবস্থা, চারদিকের বাউন্ডারি ও গ্রিন বেল্ট নির্মাণ করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, "আমরা বনানীর শহীদ যায়ান মাঠটিসহ উত্তরের সবগুলো মাঠ পরিচালনার জন্য নীতিমালা করছি এবং মাঠগুলোর দায়িত্ব থার্ড পার্টির কাছে দেওয়া হবে। এখন যেভাবে চলছে সেভাবে আর চলবে না। একটি মাঠ সবাইকে ব্যবহারের জন্য তো সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না। তাই নীতিমালা হলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে।"