রাত-বিরাতে ফোনকল, হয়রানি: অভিভাবকদের কাছে যেন ‘জিম্মি’ দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষকেরা
গত ৫ জুন লি মিন-সো (ছদ্মনাম) তার ডায়েরিতে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের সময় যে ভয়ের শিকার হন, তা এভাবে লেখেন: 'আমার বুকের ওপর যেন কোনোকিছু চেপে বসেছিল। মনে হচ্ছিল, আমি ওপর থেকে পড়ে যাচ্ছি। আমি কোথায় আছি, জানি না।'
এরপর ৩ জুলাই এই প্রাইমারি স্কুলশিক্ষিকা লেখেন, কাজের মাত্রাতিরিক্ত চাপে তিনি এতটাই হয়ে পড়েছেন যে চাকরি ছেড়ে দিতে চান।
এর দুই সপ্তাহ পর ২৩ বছর বয়সি এই শিক্ষিকাকে তার শ্রেণিকক্ষের স্টোর কাবার্ডে মৃত অবস্থায় পান তার সহকর্মীরা। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। সোমবার হাজার হাজার শিক্ষক কর্মস্থলে আরও ভালো কাজের পরিবেশের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, উদ্ধত অভিভাবকেরা তাদের নিয়মিত হেনস্তা, হয়রানি করেন। কর্মদিবস তো বটেই, ছুটির দিনেও তাদেরকে অনবরত ফোনকল করেন এই অভিভাবকেরা, অযৌক্তিক সব বিষয়ে অভিযোগ করেন ফোন করে।
মিন-সোর কাজিন পার্ক দু-ইয়ং বিবিসিকে বলেন, মিন-সো এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছিলেন। মায়ের পথ ধরে শিক্ষক হওয়া মিন-সোর ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল। বাচ্চাকাচ্চা তিনি খুব পছন্দ করতেন।
মিন-সোর মৃত্যুর পর তার ডায়েরি, কাজের লগ ও টেক্সট মেসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেন পার্ক। এসব ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পেরেছেন, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা রীতিমতো নালিশের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন মিন-সোর কাছে। এই যেমন, সম্প্রতি মিন-সোর এক শিক্ষার্থী আরেক বাচ্চার পেন্সিল দিয়ে আঁচড় কেটেছিল। এর জেরে ওই বাচ্চা বাবা-মা গভীর রাতেও ফোনকল আর মেসেজ করে জেরবার করে ফেলেছিলেন মিন-সোকে।
গত ছয় সপ্তাহ ধরে হাজার হাজার শিক্ষক সিউলে বিক্ষোভ করেছেন। শিক্ষকরা বলছেন, তারা ভয় পাচ্ছেন যে এখন তাদেরকে শিশু নিপীড়নকারীর তকমা দেওয়া হতে পারে; শিক্ষার্থীরা ঝগড়াঝাঁটি কিংবা মারামারি বাধালে তাদের শাসন কিংবা থামাতে যেতেও পারেন না তারা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, অভিভাবকরা ২০১৪ সালের একটি শিশুকল্যাণ আইনের অন্যায় ব্যবহার করছেন। ওই আইন অনুসারে, যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ আসবে, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বরখাস্ত হয়ে যাবেন।
কোনো শিশু সহিংস হয়ে উঠলে তাকে বাধা দিলেও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিশু নিপীড়নের অভিযোগ আনা যায়। আবার কোনো শিশুকে কড়া কথা বা বকা দেয়া হলে সেটিকে মানসিক নিপীড়ন হিসেবে তকমা দেওয়া হয়। এ ধরনের অভিযোগের ফলে শিক্ষকরা তৎক্ষণাৎ চাকরি হারাতে পারেন।
এক দম্পতি এক শিক্ষককে অনুরোধ করেছিলেন তাদের সন্তানকে যেন ওই শিক্ষক প্রতিদিন সকালে ফোন করে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেন। ওই শিক্ষক এ অনুরোধ না রাখায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সেই শিক্ষার্থীর বাবা-মা।
আরেক ঘটনায় একটি ছেলে কাঁচি দিয়ে তার সহপাঠীর গায়ে জখম করেছিল। সেজন্য তার 'রিওয়ার্ড স্টিকার' (পুরস্কার হিসেবে দেওয়া স্টিকার) ফিরিয়ে নেওয়া হলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ করা হয়।
কিম জিন-সেও নামের একজন শিক্ষক জানান, একবার তিনি শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন তাদের দুষ্টু চিন্তা যেন টয়লেটে জমা রাখে। আরেকবার এক শিশু মারামারি করলে সেই ঘটনা তিনি শিশুটির বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন। এই দুটি ঘটনায়ই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে।
কিম বলেন, তার অবস্থা এমন হয়েছে যে এখন আর নিরাপদে শ্রেণিকক্ষে পড়াতে পারবেন বলে মনে হয় না তার। এমনকি তিনি আত্মহত্যার চিন্তাও করেছেন।
এই অভিযোগ-নালিশের মূলে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার অতি-প্রতিযোগিতামূলক সমাজ। দেশটিতে সবকিছুই নির্ভর করে একাডেমিক সাফল্যের ওপর। শৈশব থেকেই শিশুদেরকে সেরা গ্রেডের জন্য ভয়ানক প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, যাতে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারে। স্কুলের বাইরেও শিশুদের অতিরিক্ত পড়াশোনার জন্য 'হ্যাগওয়নস' নামক ব্যয়বহুল স্কুলে পাঠান বাবা-মায়েরা। এসব স্কুল ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। আগে কোরিয়ায় একেকটি পরিবার পাঁচ থেকে ছয়টি সন্তান নিত, এখন অধিকাংশ পরিবারই এক সন্তান নেয়।
সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অভ এডুকেশনের অধ্যাপক কিম বং-জি বলেন, ক্রমবর্ধমান বৈষম্যও বর্তমান সমস্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
তিনি বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে কোরিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান করার অত্যন্ত মজবুত সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু দেশটির দ্রুতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অনেক বাবা-মাই এখন উচ্চশিক্ষিত। 'এর ফলে তারা প্রায়ই শিক্ষকদের নিচু নজরে দেখেন। তারা মনে করেন নিজেদের কর দিয়ে তারা এই শিক্ষকদের বেতন দিচ্ছেন। এই মানসিকতা তাদের মধ্যে অতিরিক্ত অধিকারবোধ তৈরি করে,' বলেন তিনি।
কুয়োন নামের আরেক শিক্ষক বিবিসিকে জানান, গত ১০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন তিনি। এই দশ বছরে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের চাপের ফলে সৃষ্ট বিষণ্ণতা ও প্যানিক অ্যাটাকের জন্য তিনি দুবার অসুস্থতাজনিত ছুটি নিয়েছেন।
কুয়োন বলেন, চার বছর আগেও অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ বের করে দেওয়া যেত অথবা রুমের পেছনে পাঠানো যেত। কিন্তু এরপর অভিভাবকরা শিশু নির্যাতনের জন্য মামলা শুরু করেন। কুয়োন সম্প্রতি তুলনামূলক দরিদ্র এলাকার একটি স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। তিনি জানান, ধনী এলাকার অভিভাবকদের আচরণ অনেক বেশি জঘন্য।
'তাদের মানসিকতা এরকম: "শুধু আমার সন্তানই গুরুত্বপূর্ণ"। মানুষ যখন শুধু নিজের সন্তানকেই ভালো কলেজে পাঠানোর কথা ভাবে, তখন সে ভীষণ স্বার্থপর হয়ে ওঠে,' কুয়োন বলেন। তিনি নিশ্চিত, এই চাপ বাচ্চাদের মধ্যেও কাজ করে, এর প্রভাব পড়ে তাদের আচরণেও। 'এই চাপ থেকে কীভাবে মুক্ত হবে, তা ওরা জানে না। সেজন্যই একে অপরকে আঘাত করে।'
দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বুলিং ও সহিংসতা খুব পরিচিত সমস্যা। গত বছরের জনপ্রিয় কে-ড্রামা 'দ্য গ্লোরি'র কাহিনি বোনা হয়েছে এক নারীকে ঘিরে, যে কিনা তাকে যারা বুলি করত, তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। ড্রামাটি সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ভয়ানক কিছু সহিংসতা দেখানো হয়েছে। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, খোদ এই ড্রামার পরিচালকের ওপরই বুলিংয়ের অভিযোগ আনা হয়; শেষপর্যন্ত তিনি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই সমস্যার সমাধানের জন্য চাপে থাকা কোরিয়া সরকার ঘোষণা দেয়, শিক্ষার্থীদের বুলিংয়ের রেকর্ড তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। শিক্ষার্থীদের পরস্পরকে বুলি না করতে উৎসাহ দেয়ার জন্য এ ঘোষণা দেওয়া হলেও, উল্টো অভিভাবকরা এ নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। এর ফলে নিজেদের সন্তানের ভুলত্রুটি ও অপরাধ রেকর্ড থেকে মুছে ফেলার জন্য শিক্ষকদের ওপর পাহাড়সম চাপ তৈরি করছেন তারা।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানবাধিকার রক্ষার্থে কাজ করা একটি সংগঠন চালান শিন মিন-হিয়াং। তিনি স্বীকার করেন, গত কয়েক মাসে অভিভাবকদের যেসব আচরণের কথা তুলে ধরা হচ্ছে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য। তবে তিনি দাবি করেন যে, এসব কারণ বাহ্যিক।
শিন বলেন, 'অভিভাবকদের বিশাল একটা অংশ ভালো আচরণ করেন। নিজেদের উদ্বেগের বিষয়ে জানাতে আমরা যেসব চ্যানেল ব্যবহার করি, সেগুলো এখন বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে আশঙ্কা করছি। অভিভাবকদের নাটের গুরু হিসেবে ফাঁসানো হচ্ছে, এটা ঠিক না।'
তবে শিন স্বীকার করেন যে অতীতে তিনি শিক্ষকদের ব্যাপার অভিযোগ করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বিবিসিকে একটি গ্রুপ চ্যাটের আলোচনা দেখান। ওই গ্রুপ চ্যাটে দেখা যায়, অভিভাবকরা একজন শিক্ষকের নেওয়া একটি সিদ্ধান্তের জন্য তাকে হেনস্তা করতে পরস্পরকে উৎসাহ দিচ্ছেন। চ্যাটে একজন অভিভাবক লিখেছেন, 'আপনার [ফোন] নম্বর ব্লক করে দিলে পরিবারের অন্য কারও অথবা বন্ধুদের ফোন থেকে কল করুন।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিভাবক বলেন, 'সমস্যা তৈরি করে এমন শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শিক্ষকদের হাতে না থাকলে অন্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।'
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়ানোর মতো শিক্ষকের সংখ্যাও কমে যেতে পারে। ২০২৩ সালের এক জরিপ অনুসারে, কোরিয়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪ শতাংশ) তাদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট, অথচ ২০০৬ সালেও এ হার ছিল ৬৮ শতাংশ। গত বছর শিক্ষকদের বড় একটা অংশ বলেছেন যে তারা এই পেশা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন।
কোরিয়া সরকারও স্বীকার করেছে যে, দেশটির শ্রেণিকক্ষ 'ভেঙে পড়েছে'। শিক্ষকদের জন্য জারি করা নতুন গাইডলাইনে সরকার বলেছে, শিক্ষকরা উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ থেকে বের করে দিতে পারবেন—প্রয়োজনে তাদের শাসনও করতে পারবেন। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আগে থেকে ঠিক ক্রএ রাখা তারিখ ও সময় অনুযায়ী শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে বাবা-মায়েদের রাজি হতে হবে। এছাড়া শিক্ষকরা স্কুলের সময়ের পরে কারও সঙ্গে দেখা না করার অধিকারও রাখবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষামন্ত্রী লি জু-হো বলেছেন, তিনি আশা করেন এসব পদক্ষেপ স্কুলগুলোকে ঠিক করতে পারবে।
কিন্তু বহু মানুষ বলছেন, শুধু শ্রেণিকক্ষই 'ভেঙে পড়েনি'—বরঞ্চ দক্ষিণ কোরিয়ার গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই সংস্কার করা দরকার। সেইসঙ্গে পাল্টানো দরকার সমাজের সাফল্যের সংজ্ঞাও।