আমদানি সহজ করার উদ্যোগে অগ্রগতি সামান্যই
দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সহজ করার লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের অথরাইজড ইকোনোমিক অপারেটর (এইও) হিসেবে স্বল্প সময়ে বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করার উদ্যোগ নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে বিস্তর আলোচনা হলেও এক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে একেবারেই সামান্য।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মাত্র ১৫টি প্রতিষ্ঠান এইও হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এইও হলো এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পণ্যের কোনো ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন ছাড়াই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্দর থেকে ঝামেলামুক্তভাবে পণ্য খালাস করতে পারেন; যার জন্য বর্তমানে গড়ে ১১ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
তবে দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে ২০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকলেও এইও'র জন্য আবেদন করেছে খুবই কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠান।
আবার যেসব প্রতিষ্ঠান এইও হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তারা ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন ছাড়া বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করার সুবিধা বাস্তবে পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগ স্বীকারও করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
মোট ৯০টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও ৭৫টি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধার আওতায় আসতে পারেনি।
এদিকে, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের বাদ পড়ার কারণ হিসেবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্ধারিত ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহারের শর্তসহ এনবিআরের ক্রাইটেরিয়া পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা চাইলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এইও সুবিধার আওতায় আনতে পারছে না।
এইও'র বিষয়টি দেখভাল করা এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস ভ্যালুয়েশন অ্যান্ড ইন্টারনাল অডিট কমিশনারেটের কমিশনার (যিনি গত সপ্তাহে নতুন অফিসে বদলি হয়েছেন) এনামুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এনবিআরের যে ক্রাইটেরিয়া (শর্ত) রয়েছে, তা পূরণ না করলে আমরা তো তাদের এ সুবিধা দিতে পারি না।"
তিনি বলেন, "প্রতিষ্ঠানগুলোর এনবিআর নির্ধারিত ভ্যাট সফটওয়্যার না থাকলে, কিংবা ডকুমেন্ট আপডেটেড না থাকাসহ কিছু লিমিটেশন্সের কারণে তাদেরকে এইও দেওয়া যাচ্ছে না। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ কারণেই আটকে যাচ্ছে। আমরাও এক্ষেত্রে ছাড় দেব না।"
"প্রতিষ্ঠানকে সেন্ট্রালি ভ্যাট রেজিস্টার্ড হওয়ার শর্ত রয়েছে, বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (বিআইএন) নম্বর সিঙ্গেল হতে হয়। কিন্তু আমরা পরীক্ষা করে দেখছি একাধিক বিআইএন রয়েছে। আবার প্রতিষ্ঠানের প্রিমিজেসে (আমদানিকৃত পণ্য যে ওয়্যারহাউজে থাকবে) সঠিক সিকিউরিটি নেই কিংবা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সিগনেটরি প্রতিনিধি থাকেনা। এইও না পাওয়ার পিছনে এ ধরনের আরও কিছু কারণ রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এ সংক্রান্ত নিয়ম-নীতি কঠোর হওয়া এবং ব্যবসায়ীদের প্রতি কাস্টমস বিভাগের আস্থার অভাবে তারা এইও পাচ্ছেন না।
এক বছরেরও বেশি সময় আগে এইও'র জন্য আবেদন করেছিল এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেড। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এনবিআরের নির্ধারিত ভ্যাট সফটওয়্যার ব্যবহার না করায় এ সুবিধার আওতায় আসতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিজানুর রহমান বলেন, "আমরা শিগগিরই ভ্যাট সফটওয়্যার চালু করবো।"
মূলত এসব কারণেই বাণিজ্য সহজীকরণের এমন একটি চমৎকার উদ্যোগ এখন পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখতে পারছে না।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এনবিআরেরই প্রকাশ করা টাইম রিলিজ স্টাডি (টিআরএস)-তে দেখা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে আমদানিকৃত পণ্য খালাসে গড়ে সময় লাগে ১১ দিন ৬ ঘন্টা, যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। ২০১৪ সালের একই টিআরএসের তুলনায় প্রায় সাত বছর পরও পণ্য খালাসে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
বিশ্বব্যাংক লজিস্টিক পারফরমেন্স ইনডেক্স (এলপিআই) ২০১৮ অনুযায়ী, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত এবং কম্বোডিয়াসহ সমস্ত প্রধান প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এছাড়া, ছয়টি এলপিআই সূচকের মধ্যে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে বাংলাদেশের পারফর্মেন্সই সবচেয়ে খারাপ।
প্রত্যাশিত সাফল্য পূরণে ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুতির অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ টিবিএসকে বলেন, "কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সহজ করার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগটি ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু এখানে অগ্রগতি না হওয়ার জন্য দুই পক্ষেরই দায় আছে।"
"যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া যাকে-তাকে এই সুবিধা দিয়ে দিলে অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। ফলে কমপ্লায়েন্স যাচাই করতে হবে। আবার এনবিআরের রুলস-রেগুলেশনসও এজন্য সহায়ক হওয়া দরকার," বলেন তিনি।
এ ব্যপারে তিনি কাস্টমস ডিপার্টমেন্টকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
শুল্ক বিভাগের সাবেক এনবিআর সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "২০১৪ সাল থেকে এইও নিয়ে কথা হলেও এতদিনে এতে প্রত্যাশিত সফলতা না আসার অন্যতম কারণ হলো- এনবিআরের প্রস্তুতির ঘাটতি। এজন্য যে ডিজিটাল এনভায়রনমেন্ট দরকার, তা এখনো তৈরি হয়নি।"
এনবিআরের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরগুলোর যে অটোমেশনের দরকার, তাও ঠিকভাবে হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মো. ফরিদ উদ্দিন আরও বলেন, "শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। রাষ্ট্র যে পরিবেশ তৈরি করবে, ব্যবসায়ীরা সেভাবেই চলবে।"
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি মুনির হোসেন টিবিএসকে বলেন, "হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৫টি এইও হওয়ার অর্থ হলো এতে সফলতা আসেনি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষর এ সংকান্ত টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের কারণেই হয়তো এমনটি হয়েছে।"
এইও সনদ দিলেও মাঠ পর্যায়ে নেই বাস্তবায়ন
২০১৯ সালের শুরুর দিকে এনবিআর প্রথমবারের মত তিনটি শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানিকে পরীক্ষামূলক এইও সুবিধা দেয়। এরপর চলতি বছরের মার্চে আরও ৯টি প্রতিষ্ঠানকে এই সনদ দেওয়া হয়। আর গত ৩০ আগস্ট সনদ দেওয়া হয় নতুন তিন প্রতিষ্ঠানকে।
এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা বন্দরে নিতে পারছে না বলে জানায়।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, "কথা ছিল এইও সনদধারীরা বন্দরে পণ্য আসার সাথে সাথে সরাসরি গোডাউনে নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু তা এখনও শুরু হয়নি। এর মাধ্যমে যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা আমরা পাচ্ছি না।"
একটি শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানির সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, তারা বাস্তবে সুবিধাটি পাচ্ছেন না কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, "সব নিয়ম অনুসরণ করা সত্ত্বেও আমাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট পণ্য খালাসে এইও সুবিধার কথা (ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন ছাড়া) বললে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, তাদের কাছে এমন কোনো নির্দেশনা নেই, এজন্য দেওয়া যাবে না।"
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো আমদানিকারকের পক্ষে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরও জানান, "আমাদের প্রতি তাদের হয়তো আত্মবিশ্বাস কম। যদি তাই হবে, তাহলে দিলেন কেন (এইও সনদ)?"
এমন অভিযোগ স্বীকার করে এনামুল হক বলেন, "ডিজিটালি তাদেরকে আইডেন্টিফাই করার জন্য আমাদের ব্যবস্থাপনায় যে সংশোধনী দরকার, এগুলোর কাজ এখনো চলছে। এগুলো সম্পন্ন হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে।"
অবশ্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, এইও সনদধারীরা আবেদন করলে তাদের প্রাপ্য সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
যে সুবিধা পাওয়ার কথা এইও প্রতিষ্ঠানের
এইও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হওয়ার কথা পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর আগেই প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট অনলাইনে পরীক্ষা করে কাস্টমস সংক্রান্ত প্রসিডিউর সম্পন্ন হবে।
বন্দরে পণ্য বা কাঁচামাল আসার ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোনো ধরনের ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন ছাড়া তা সরাসরি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ওয়্যারহাউজে যাবে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চাইলে ওয়্যারহাউজে গিয়ে পণ্য পরীক্ষা করবেন।
এছাড়া কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ হবে অনলাইনে, দ্রুততার সাথে। স্বল্প সময়ে ডিউটি ড্র ব্যাক পাওয়া, কোনো ডিসপ্যুট হলে তা দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অলটারনেটিভ ডিসপ্যুট রিজল্যুশন (এডিআর) এর মাধ্যমে সমাধানসহ আরও কিছু সুবিধা প্রাবেন তারা।
সুফল পেতে এইও'র নিয়মকানুন সহজ করার উদ্যোগ
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এইওকে আরও কার্যকর করতে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ নতুন নীতিমালা ও স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তৈরি করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এর খসড়া তৈরি হয়েছে। শিগগিরই এটি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান এনামুল হক।
তিনি বলেন, "আমরা আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন পলিসি ও এসওপি চূড়ান্ত হবে। আশা করছি, এর মাধ্যমে এইও আরও গতি পাবে।"
নতুন এসওপি বিদ্যমান ব্যবস্থার তুলনায় আরও সহজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।