'স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়': নারীবিদ্বেষের গভীরে অনুসন্ধান
সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশের তরুণ পেসার তানজিম হাসান সাকিবের। ম্যাচটিতে বল ও ব্যাট হাতে বেশ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন তিনি। যেকোনো ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের জন্যই যেন এটি অনেকটা স্বপ্নের মতো।
গত শুক্রবার কলম্বোর রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে বাংলদেশের সুপার ফোরের শেষ ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের বোলিংয়ের ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মার উইকেটটি শিকার করেন তানজিম সাকিব। এমনকি টানটান উত্তেজনার ম্যাচটির শেষ ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ১২ রান। তখন ২০ বছর বয়সী এই তরুণের হাতেই বল তুলেন ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসান। অধিনায়কের দেওয়া দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই সামলে নেন তিনি। শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতে নেয় ৬ রানে।
ম্যাচটি জেতার পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই বাংলদেশের ক্রিকেটপ্রেমী কোটি কোটি দর্শকেরা জাতীয় দলের নবাগত এই তারকাকে বেশ প্রশংসায় ভাসাচ্ছিলেন। তরুণ সাকিবও যেন সফলতাকে বেশ উপভোগ করছিলেন। কিন্তু বিপত্তির শুরু হয় যখন নেটিজেনদের একটা অংশ এই ক্রিকেটারের পুরনো কিছু কর্মকাণ্ড (অপকর্ম) সামনে নিয়ে আসেন।
মূলত ম্যাচ শেষে সাকিবের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বেশকিছু পুরনো পোস্ট ক্রিকেটপ্রেমীদের টাইমলাইনজুড়ে ঘুরতে থাকে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে টাইমলাইনে ঘুরতে থাকা ক্রিকেটারের ঐ পোস্টগুলো বেশ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির।
যারমধ্যে সাকিবের পুরোনো একটি পোস্টে লেখা, "স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।"
তবে এখানেই শেষ নয়। আরেকটি পোস্টে সাকিব লিখেছিলেন, "ভার্সিটির ফ্রি মিক্সিং আড্ডায় অভ্যস্ত মেয়েকে বিয়ে করলে আর যাই হোক, নিজের সন্তানের জন্য একজন লজ্জাশীলা মা দিতে পারবেন ন!" যদিও পরবর্তীতে এই পোস্টটি তিনি মুছে ফেলেছেন।
তানজিম সাকিবের পোস্টগুলো নারীদের জন্য অবমাননাকর। শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে। এইসব বিদ্বেষমূলক পোস্টের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে প্রকাশ পায় যে, সাকিব ব্যক্তিগত জীবনেও এই মতাদর্শই ধারণ করেন।
এদিকে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে কিছু ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এমন ধারণা পোষণ করা ক্রিকেটারকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত করায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিছু ব্যবহারকারী আবার তানজিম সাকিবকে ক্রিকেট দল থেকে বহিস্কারের দাবি জানাচ্ছেন।
তাদের যুক্তি এই যে, এমন গোঁড়া মতাদর্শী কাউকে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অংশ করা উচিত নয়। কেননা দেশের তরুণ প্রজন্ম তাদের রোল মডেল হিসেবে দেখে জাতীয় দলের এই ক্রিকেটারদের।
তবে পুরো বিষয়টিকে বিবেচনা না করে শুধু তানজিম সাকিবের বিরুদ্ধেই যদি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সেক্ষেত্রে কেবল ঐ নির্দিষ্ট ঘটনাটির বিরুদ্ধেই হয়তো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া এবং এর বাইরেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ যে প্রকৃতপক্ষে তানজিম সাকিবের এমন মতামতকেই সমর্থন করে, সেটি বিবেচনায় আনাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি বুঝতে একটি সাম্প্রতিক জরিপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জরিপটির ফলাফলে দেখা যায়, ১৮ বছরের কমবয়সী দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছেলেরা মনে করে, নারীদের খুব বেশি বাড়ির বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। এই ফলাফল অনেকের কাছেই, বিশেষ করে এই সংবাদপত্রের পাঠকদের কাছে হয়তো আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। তবে বাস্তব অবস্থা অনেকটাই এমনই।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন। যেখানে এমন কিছু উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ১৮ বছর বয়সের কমবয়সী প্রায় ৬১.৬৫ শতাংশ ছেলেদের শিশু পর্ণোগ্রাফি দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়াও ৫৬.৬৫ শতাংশ ছেলেরা মনে করে যে, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষদেরই চূড়ান্ত মতামত প্রদানের ক্ষমতা থাকা উচিত। ৫৭.৪৫ শতাংশ ছেলে তাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণে বল প্রয়োগের চিন্তা করে থাকে। আর ৬৬.২ শতাংশ ছেলেরা মনে করে যে, নারীদের বেশি বাড়ির বাইরে যাওয়া উচিত নয়।
এক্ষেত্রে অনেক কিশোরের কাছে পর্নোগ্রাফিই প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎস বলে জানান অধ্যাপক সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "এর ফলে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের হার বাড়ছে। আমাদের ছেলে মেয়েরা এখন অনেক স্মার্ট। তাদের দোরগোড়ায় সহায়ক বিনোদন পৌঁছে দিতে হবে। তারা অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর। তাই তাদের জন্য নিউ মিডিয়ার কন্টেন্ট তৈরি করা দরকার।"
কিশোর-কিশোরীদের উপর পর্নোগ্রাফির ক্ষতিকর প্রভাবের পাশাপাশি, নারীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত রক্ষণশীল ধর্মীয় বক্তব্য প্রকাশের প্রভাবকেও সাকিবের চরমপন্থী বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। কেননা তরুণ এই ক্রিকেটারের অ্যাকাউন্ট ঘুরে দেখা যায় যে, তিনি নিয়মিত কিছু ধর্মীয় বক্তার ভিডিও এবং লিখিত বক্তব্য শেয়ার করেন।
এটা প্রায় সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশে ধর্মীয় বক্তারা তাদের বক্তৃতায় নারীদের সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণের মানসিকতাকে প্রভাবিত করেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমনভাবে আলোচনা করা হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সাদেকা হালিম ২০২১ সালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কিছু ধর্ম প্রচারক তাদের বক্তৃতায় নারীদের নিয়ে অশ্লীল কথা বলছেন। পুরুষ কর্তৃক নারীর মানসিক ও শারীরিক নিয়ন্ত্রণের কথাও বলে থাকেন তারা। তাদের বক্তৃতায় দেশের অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদেরও সমালোচনা করা হয়। এসব বিষয় সমাজে স্থায়ী প্রভাব ফেলে।"
বলা বাহুল্য যে, অধ্যাপক সাদেকা হালিম 'সমাজের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব' বলে যেটি উল্লেখ করেছিলেন সেটি পূর্বে উল্লিখিত গবেষণার ফলাফলেও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত 'এসআরএইচআর অফ দ্য পারসনস উইথ ডিজেবিলিটিস অ্যান্ড মেল ইয়ুথ ইন বাংলাদেশ' নামের একটি রিসার্চ প্রজেক্টের অংশ হিসেবে এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩২ শতাংশ যুবক মনে করেন, 'পারিবারিক ঐক্য বজায় রাখতে একজন নারীকে সহিংসতা সহ্য করে নেওয়া উচিত!"
গবেষণার ফলাফলগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে নারীবিদ্বেষ শুধু কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল কিংবা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি যেন অনেকটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের সামগ্রিক এই নেতিবাচক পরিস্থিতি উপেক্ষা করে সবেমাত্র কিশোর বয়স পেরিয়ে আসা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন আসবে না। তাই সমস্যার মূল কারণগুলি গভীরভাবে অনুসন্ধান করে সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে।
এক্ষেত্রে সমাধানের অংশ হিসেবে পাঠ্যক্রম পুনর্বিবেচনা করে জেন্ডার-সংবেদনশীল কন্টেন্ট যুক্ত করতে হবে। তবে শুধু এটিই যথেষ্ট নয়। পাশপাশি অনলাইন স্পেসকে জেন্ডার-সংবেদনশীল করতে হবে। এছাড়াও সকল বয়স, সামাজিক শ্রেণী এবং জেন্ডারের মানুষের জন্য অনলাইন স্পেসকে সার্বিকভাবে নিরাপদ জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
তবে তাই বলে ক্রিকেটার তানজিম সাকিবের ঘটনাটিও এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এক্ষেত্রে ইসিবিকে অনুসরণ করতে পারে। কেননা ইংল্যান্ডের বোলার অলি রবিনসনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ একটি ঘটনা উঠে এসেছিল।
প্রায় দুই বছর আগে লর্ডসে রবিনসনের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। তবে বিপত্তি বাধে যখন ২০১২ ও ২০১৩ সালে এই ক্রিকেটারের করা বর্ণবাদী ও যৌন বৈষম্যমূলক টুইট সামনে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়; যে পর্যন্ত না তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আসে। সবশেষে তাকে আটটি ম্যাচে নিষিদ্ধ করা হয় এবং ৩২০০ পাউন্ড জরিমানা করা হয়।
রবিনসন তার অতীতের অপকর্ম সত্ত্বেও দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ পেয়েছেন। কেননা এক্ষেত্রে অপরাধের সময় ইসিবি তার বয়সকে বিবেচনা করেছে। তবে ইসিবির পক্ষ থেকেও সমস্যাটির সমাধানে দ্রুত কাজ করা হয়েছে। একইসাথে তারা বর্ণবাদ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' অবস্থান প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও এক্ষেত্রে একই পথ অনুসরণ করতে পারে। তবে তানজিম সাকিবকে পুরোপুরি ব্যান বা সানপেন্ড করে দেওয়া সম্ভবত বেশ কঠোর শাস্তি হয়ে যাবে। বিশেষ করে তার বয়স মাত্র ২০ বছর, এই বিষয়টি বিবেচনা করলে। তবুও ক্রিকেট বোর্ডের অবশ্যই এটা বলতে হবে যে, পোস্টে উল্লেখিত সাকিবের লেখাগুলো নিঃসন্দেহে ভুল ছিল। একইসাথে তাকে সংশোধনের প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে কাজ করতে হবে।
বিসিবি এমন পদক্ষেপ নিলে স্পষ্ট হবে যে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে নারীবিদ্বেষের কোনো স্থান যে নেই, পাশাপাশি এই ধরনের আচরণকারীদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।