ক্রমাগত লোকসানের মধ্যে বন্ধ হচ্ছে জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ইতালি
নিজস্ব উপায়ে রেমিট্যান্সে সংগ্রহে যখন দেশের কিছু ব্যাংক নতুন এক্সচেঞ্জ হাউজ খুলতে আবেদন করছে ঠিক সেই সময়েই লোকসানের কারণে প্রায় ২১ বছর পুরনো জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (এসআরএল) ইতালি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ ১৩ বছর টানা লোকসান করছে জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ইতালি। এসব লোকসান পুনঃভরন করতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে।
গ্রাহকের আমানতের সুরক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমুন্নত রাখতে এই লোকসানী প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে প্রায় ৪৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা লোকসান বাবদ দিতে হয়েছে।
এছাড়া জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ২০২১ ও ২০২২ সালের লোকসান ব্যয় মেটানোর জন্য প্রায় ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা তাদের কভার ফান্ড থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সংরক্ষণ করে।
ধারাবাহিক লোকসান অব্যাহত থাকায় গত আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি ডিপার্টমেন্ট থেকে গভর্নর বরাবর এই এক্সচেঞ্জ হাউজ নিয়ে নোট উপস্থাপন করে। পত্রটিতে প্রতিষ্ঠানটি এক যুগের বেশি সময়ে লোকসান অব্যহত থাকায় এটি পুরোপুরি বন্ধের জন্য গভর্নর বরাবর উপস্থাপন করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, জনতা এক্সচেঞ্জ হাউজ (জেইসি) ইতালি বন্ধের জন্য উপস্থাপিত প্রস্তাবে গভর্নর সম্মত হয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি চিঠি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।
জনতা ব্যাংকের ওভারসিজ বিভাগটি দেখেন প্রধান কার্যলয়ের জিএম আনিসুর রহমান। তিনি টিবিএসকে বলেন, "এক্সচেঞ্জ হাউজটি বন্ধের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি পেয়েছি। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আমাদের বক্তব্য পত্রের মধ্যেমে উপস্থাপন করবো।"
জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ইতালির প্রতিষ্ঠা
জনতা এক্সচেঞ্জ হাউজ (জেইসি) ইতালি ২০০২ সালে রোমে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর একই দেশের মিলানে দ্বিতীয় শাখার মাধ্যমে তারা ব্যবসায়ীক কার্যক্রম সম্প্রসার করে।
প্রতিষ্ঠানটি ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত লাভজনক অবস্থানে ছিল। এই সময় প্রতিষ্ঠানটি দেশে লাভের ৫.৯৬ লক্ষ ইউরো পাঠিয়েছে।
এরপর ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি আর লাভের মুখ দেখেনি।
জনতা ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে প্রফিটে না আসার কারণ অপারেটিং প্রফিটের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
"প্রতিষ্ঠানটির আয়ের প্রধান উৎস ছিল রেমিট্যান্স কমিশন। অথচ ইতালিতে প্রবাসী ক্রমান্বয়ে বাড়লেও রেমিট্যান্স ফ্লো কম ছিল। কিছু কর্মকর্তা উচ্চ বেতন নিত কিন্তু গ্রাহকদের কাছে যেত না। যার কারণে ক্রমন্বয়ে লোকসান বাড়তে থাকে," বলেন তিনি।
এজেন্সি অপারেশন চালুতে ব্যর্থতা
জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ইতালির লোকসান কমাতে না পেরে ২০১৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সমন্বয়ে একটি সভা হয়। শুধুমাত্র এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে লাভজনক করা সম্ভব নয় বিধায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ৫টি এজেন্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ওই সভায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৫ সালেই প্রতিষ্ঠানটিকে পাঁচটি এজেন্ট নিয়োগের অনুমোদন করে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সাল পর্যন্ত এজেন্সি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন সময়ে পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছে তারা এজেন্সি অপারেশন পেতে ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
বিদেশি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা টিবিএসকে জনান, ইউরোপ কোন প্রতিষ্ঠানকে মানি ট্রান্সফারের লাইসেন্স দিতে বিভিন্ন বিষয় দেখে। এরমধ্যে রিকস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, নন কমপ্লায়েন্স ইস্যু, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ভুমিকা, এছাড়া প্রতিষ্ঠান রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট ও ক্যাপিটালের সার্বিক অবস্থাও রয়েছে।
তিনি বলেন, "জনতা ব্যাংক এজেন্ট কর্পোরেশন না পাওয়ার কারণ হলো প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা।"
এক্সচেঞ্জ হাউজ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তসমূহ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পত্রে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস প্লানের পরেও লোকসান বাড়ছে।
জনতা ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা, ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমুন্নত রাখার স্বার্থে এক্সচেঞ্জ হাউজ বন্ধ করা উচিত।
প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের কারণ হিসেবে পত্রে আরো বলা হয়, জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ২০২১ ও ২০২২ সালের ব্যয় মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই তাদের কভার ফান্ড ব্যবহার করে।
ইতালিতে বাংলাদেশী প্রবাসী
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইতালিতে বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে ৭৭,১৩৩ জন। তবে, দেশটিতে বর্তমানে বাংলাদেশি প্রবাসী ২ লাখেরও বেশি হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইতালির প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১০৫৪ মিলিয়ন ডলার, যারমধ্যে জনতা ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে এসেছে ২৯ মিলিয়ন ডলার বা ২.৮৩%।