কে এই লকল্যান? ফক্স নিউজ ও মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি
অবশেষে রুপার্ট মারডকের বড় ছেলে লকল্যান মারডকের অপেক্ষার অবসান ঘটছে যাচ্ছে। খুব শীঘ্রই বাবার বিশাল মিডিয়া সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তিনি। বহুদিন ধরে হয়তো ঠিক এই সময়টির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন মারডকের দ্বিতীয় স্ত্রী আনার এই ছেলে।
গত সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিখ্যাত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ফক্স কর্পোরেশন ও নিউজ কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ৯২ বছর বয়সী মিডিয়া মোগলখ্যাত রুপার্ট মারডক। তার জায়গায় দায়িত্ব নেবেন বড় ছেলে লকল্যান মারডক। রক্ষণশীল নিউজ নেটওয়ার্ক ফক্স নিউজ, ফক্স ব্রডকাস্ট ও স্পোর্টস নেটওয়ার্ক এবং স্থানীয় টিভি স্টেশনগুলো ফক্স কর্পোরেশনের মালিকানাধীন।
বিখ্যাত ও ক্ষমতাসীন দুই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণের ক্ষেত্রে লকল্যান অবশ্য পেছনে ফেলেছেন সহোদর জেমস মারডককে। ডিজনি 'টুয়েনন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স' অধিগ্রহণের পর ২০১৯ সাল থেকেই ফক্স কর্পোরেশনের সিইওর পদে রয়েছে লকল্যান। একত্রীকরণের আগে তিনি ২০১৫ সাল থেকে টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স-এ সিইও হিসেবে কাজ করার বাইরেও বিগত বছরগুলোতে মারডকের আরেক ছেলে জেমস বিভিন্ন সময়ে নিউজ কর্পোরেশনে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোস্টসহ তাদের সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত কন্টেন্ট নিতে মতবিরোধের জেরে তিনি পরিবার-নিয়ন্ত্রিত প্রকাশক বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।
মারডক ভাইদের মধ্যে জেমস অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০২০ সালে পদত্যাগের পর তিনি বলেছিলেন, "কোম্পানির সংবাদ আউটলেটগুলোতে প্রকাশিত কিছু সম্পাদকীয় কন্টেন্ট এবং আরও কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে মতানৈক্যের কারণে" তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন।
জেমস এর আগে নিউজ কর্পের এডিটোরিয়াল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি ফক্স নিউজ কভারেজের সঙ্গে একমত নন। বর্তমানে তিনি নিজেকে কোম্পানি ও বাবার রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়েছেন।
অন্যদিকে লকল্যানের জন্ম লন্ডনে হলেও বড় হয়েছেন নিউ ইয়র্কে। ব্যবসায়ী বাবার বড় ছেলে হয়েও তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে দর্শনে লেখাপড়া করেছেন।
স্নাতক শেষে লকল্যান অস্ট্রেলিয়ায় যেয়ে নিজের বাবার সংবাদপত্রের ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। অনেকেই তখন আন্দাজ করেছিল যে, মারডক হয়তো ছেলেকে নিউজ কর্পোরেশনে আরও বড় দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তৈরি করছে।
সেই আন্দাজ কয়েক বছর পরেই সত্যি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯০' এবং ২০০০'র দশকে নিউজ কর্পোরেশন নামে পরিচিত পারিবারিক ব্যবসার নির্বাহী পদে ধাপে ধাপে উন্নীত হন লকল্যান। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ডেপুটি চীফ অপারেটিং অফিসার পদে ছিলেন। এছাড়াও তিনি ফক্স টেলিভিশন স্টেশনসের চেয়ারম্যান এবং নিউইয়র্ক পোস্টের প্রকাশক পদেও ছিলেন।
সংবাদমাধ্যম সিএনএন সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে এই নেটওয়ার্ক পরিচালনা নিয়ে কোম্পানির সাবেক শীর্ষ নির্বাহী রজার এইলসের সাথে বিবাদের পর সাময়িকভাবে কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন লকল্যান। এক দশক পরে আবার তিনি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্সের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসেন।
মাঝের ঐ বিরতির সময় লকল্যান 'ইলিরিয়া পিটিওয়াই' নামে একটি বেসরকারি বিনিয়োগ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একইসাথে ঐ সময়টাতে রুপার্টের নিউজ কর্পোরেশন বেশ বিতর্কে জড়িয়ে পরে।
বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের ফোন হ্যকিং কেলেঙ্কারির ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যার মাধ্যমে ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র 'নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' এর সাংবাদিকেরা এবং মারডকের মালিকানাধীন অন্য পাবলিকেশনগুলো অবৈধভাবে ভয়েজ মেইলে আড়ি পাতে। এই তালিকায় ব্রিটিশ রয়েল পরিবার ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাদের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরাও ছিল।
ঘটনাটি জানাজানি হলে মারডকের কোম্পানির ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরই সূত্র ধরে নিউজ কর্পোরেশনের বহু কর্মকর্তা পদত্যাগ করে, কারও কারও বিরুদ্ধে মামালাও হয়। এমনকি ২০১১ সালে 'নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' ট্যাবলয়েডটি বন্ধও হয়ে যায়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সময়ে দায়িত্ব থাকা মারডক ও ছেলে জেমসের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়। আর তাতেই লকল্যানের কোম্পানিতে ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে লকল্যান জেমসের পাশাপাশি নিউজ কর্পোরেশনের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তারই কিছুদিন পর রজার এইলসকে ফক্স নিউজ থেকে চাকরীচ্যুত করা হয়। অবশ্য তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য যৌন হয়রানির অভিযোগও ছিল।
তবে লকল্যান মারডক মিডিয়া ওয়াচডগদের কাছে তীব্রভাবে সমালোচিত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ফক্স নিউজের ক্রমবর্ধমান ষড়যন্ত্রমূলক ও ভুল তথ্য সম্প্রচারের জন্য দায়ী।
২০২০ সালের নির্বাচনে ভোটিং মেশিন নিয়ে সংবাদ প্রকাশের দায়ে ডোমিনিয়ন ভোটিং সিস্টেম কোম্পানি ফক্স নিউজের বিরুদ্ধে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের মামলা করে বসে। কোম্পানিটির অভিযোগ ছিল যে, ফক্স নিউজ ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটিং মেশিনের নিরাপত্তা নিয়ে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য প্রচার করেছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে ফক্স নিউজ ৭৮৭.৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে মামলাটি নিস্পত্তি করে। একই অভিযোগে ভোটিং মেশিন প্রস্তুতকারক কোম্পানি স্মার্টম্যাটিক' মামলা করেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এটি ট্রায়ালে যেতে পারে।