মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকিং খাত সংস্কার, রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শ আহসান এইচ মনসুরের
দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা ও ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।
জাতীয় নির্বাচনের আগে আর্থিক খাতে কোনো নীতিনির্ধারণী পরিবর্তন চায় না সরকার। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকটসহ অর্থনীতিতে বর্তমানে যে বিভিন্ন ধরনের সংকট রয়েছে– সেগুলো সমাধানে রাজস্ব বাড়ানো ও ব্যাংকিং খাত সংস্কারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে আর ঋণ না দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা প্রশমনে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেওয়ার অংশ হিসেবে বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠকে বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বৈঠকেই এমন পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে সবার আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, মূল্যস্ফীতি কমলে এমনিতেই ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
তবে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আর্থিক খাতে নীতিনির্ধারণী কোনো পরিবর্তন কিংবা সংস্কার করা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে রিজার্ভ ধরে রাখাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান করণীয় হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
এছাড়া, রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি এতে বৈচিত্র্য আনতে উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বর্তমানে জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমিয়েছে সরকার। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন আর টাকা নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে প্রয়োজন হলে এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিতে পারবে।
নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে তেমন কোনো সংস্কার আনতেও অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তবে নির্বাচনের পর দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার আনা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। তাই এই অর্থনীতিবিদের কাছ থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয় নিয়ে দুই ধরনের পরামর্শ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
স্বল্পমেয়াদী বলতে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে কী করণীয়, তার পরামর্শ চাওয়া হয় আহসান এইচ মনসুরের কাছে। আর দীর্ঘমেয়াদের পরামর্শে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারসহ নানান বিষয়।
বৈঠকের বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশের রিজার্ভকে ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছি। আর সরকারকে যেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না দেওয়া হয় সেটিও উল্লেখ করেছি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দিলেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব বাড়ানো, ব্যাংক খাতের সংস্কার ও বহুমুখী রপ্তানি খাত তৈরির পরামর্শ দিয়েছি।"
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি না করতে পারলে অর্থনীতিকে ধরে রাখা যাবে না। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আরও শক্তিশালী করতে হবে। আর ব্যাংক খাতে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে তা অর্থনীতির জন্য শুভকর হবে না। তাই এভাবে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া, নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে নীতি পরিবর্তনসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবদ। দেশের রপ্তানি খাত এখন কেবল পোশাক শিল্পকেন্দ্রীক। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পোশাক খাতে কোনো সমস্যা তৈরি হলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। তাই দেশের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনারও পরামর্শ দিয়েছেন ড. আহসান মনসুর।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, "মূল্যস্ফীতি, ডলারের দামে অস্থিতিশীলতা এবং খেলাপি ঋণ এ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন পিআরআই নির্বাহী পরিচালক। পাশাপাশি নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার ওপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।"
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংককে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামলাতে সুদের হার বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। তবে এর কোনো কিছুকেই আমলে নেয়নি আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতিসহ আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
বুধবারের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ছাড়াও অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সায়েদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাসের, সাজেদুর রহমান খান ও নুরুন নাহার।
এর আগে, গত ২১ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গেও বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।