শৈশব থেকে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে জিপিএ-৫
মো. মোখলেছুর রহমান মামুন, সমসাময়িক সময়ে পটুয়াখালীর বিষ্ময়কর এক বালক সে। নিজের স্বপ্নপূরণে সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করেছে উপার্জন। এভাবে সে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এবার জিপিএ-৫ অর্জন করেছে।
জানা গেছে, মামুনের স্বপ্ন বুননের গোড়াপত্তনটা কৃষক বাবা বারেক মাতুব্বরের হাত ধরে দক্ষিণ গেড়াখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে। সেই থেকে মামুনের স্বপ্ন দেখা শুরু। কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই ২০১৫ সালে দক্ষিণ গেড়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৪.৫০ লাভ করে মামুন। এতে তার স্বপ্নের ব্যাপ্তি আরও বাড়তে থাকে।
এর মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় বড় বোন কুলসুমের। বোনের বিয়ের পরপরই মামুনের পরিবারে বাবা বারেক মাতুব্বরের বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে সংসারে দেখা দেয় আর্থিক সংকট। বাবার খরচে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করলেও এবার তার শারীরিক অক্ষমতা এক বাঁধা হয়ে ওঠে মামুনের জীবনে। তাই সে এবার নিজেই শুরু করে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংগ্রাম।
এ সংগ্রামে তাকে পরামর্শ দেওয়ার কেউ না থাকলেও কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি মামুন।
সদর উপজেলার মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের কৃষক বারেক মাতুব্বরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কহিনুর বেগমের এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মধ্যে মামুন ছোট। ছোট বেলা থেকে মামুন ছিল বিনয়ী ও মিষ্টভাষী।
কৃষক বাবার অসুস্থতার কারনে মামুনের সংগ্রামী জীবন শুরু ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। এলাকার রাজমিস্ত্রী নজরুল ইসলামের কাছে মামুন শুরু করে রাজযোগালির কাজ। নরম হাতে এমন ইট-হাতুরি আর কোদাল চলে সমান তালে।
বিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়াশুনার পাশাপাশি চলে এ উদয়াস্ত পরিশ্রম। তবে মামুন কখনও স্কুল ফাঁকি দিত না। তার কাছে শেখার জায়গাই ছিল স্কুল।
প্রাইভেট পড়ার সামর্থ তার ছিল না। মামুনের অদম্য আগ্রহ দেখে স্কুলের শিক্ষকরাও যে যার মতো করে তাকে পাঠদানে সহযোগীতা করতে শুরু করেন। মাসের সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন রাজযোগালির কাজ করে যা আয় হতো- তা দিয়ে সংসারের ভরণ-পোষণ ও শিক্ষার ব্যয় মিটাতে হতো মামুনকে।
শুরুতে শিশু মামুনকে দিন প্রতি ৪৩০ টাকা দিয়ে সহযোগীতার হাত বাড়িয়েছেন রাজমিস্ত্রী (ওস্তাদ) নজরুল ইসলাম। এর পর বছরান্তে দিনের পারিশ্রমিকও বাড়ে মামুনের। বর্তমানে মামুন প্রতিদিন ৮০০/৮৫০ টাকা আয় করছে। এমন করে পার করছিল জীবন।
এরপর পটুয়াখালী সদর উপজেলার মরিচবুনিয়া টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন মামুন। সম্প্রতি প্রকাশিত ফলাফলে সে জিপিএ-৫ অর্জন করে। তার এ ফলাফলে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
কারণ মামুনের পারিবারিক দৈন্যতার কারনে তার বয়সের সমাজের আর দশজনের মতো করে মামুন বখে যেত পারতো। কিন্তু না, নিজের স্বপ্নে সঠিক বাস্তবায়নের তার পরিকল্পিত জীবন যাপন আজ স্বপ্ন পুরনের প্রথম ধাপ পার করলো সে।
এমন খুশির খবরের মাঝেও মামুনের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে স্বপ্নের আগামী বুনন নিয়ে। কারণ মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সে এখন বেকার। মানুষের বাড়িতে কাজ বন্ধ। এতে করে বাবা-মাসহ তিন সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণসহ ভর্তির টাকা আসবে কোথা থেকে। এমন ভাবনায় তার খুশি অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
এনিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিনিধির কথা হয় মামুনের সঙ্গে। আত্মবিশ্বাসী মামুন জানায়, সব যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে সে একজন শিক্ষক হতে চায়। তার শিক্ষায় আলোকিত করতে চায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। তার মতো জীবনসংগ্রামের শিক্ষার্থীদের নিজ খরচে পড়াশুনা করাতে চায়।
তবে প্রতিযোগীতার এ লড়াইয়ে নিজেকে কতটা যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে তা নিয়ে দুঃচিন্তাও কম নেই তার। কারণ উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অনেক টাকার।
শেষের কথাটা এভাবে বলেই শেষ করলো মামুন, 'সময়ই বলে দেবে কখন বা কিভাবে আমাকে প্রতিযোগীতার মাঠ পাড়ি দিতে হবে। তবে আমি হাল ছাড়ব না।
মামুনের মা কহিনুর বেগম বলেন, যে বয়সে আর পাঁচটা শিশুর মতো খেলাধুলায় মত্ত থাকার কথা, বাবার অসুস্থতার কারণে সেই বয়সে হাতে তুলে নেয় ইট-হাতুড়ি-কোদাল। নিজের একাগ্রতা ও শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগীতায় আজ মামুনের এমন বিষ্ময়কর ফলাফল।
মামুনের উত্তোরোত্তর সফলতা কামনা করে মরিচবুনিয়া টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন জানালেন, তার প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ৫৮ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ৫১ জন উত্তীর্ন হয়েছে। চার জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর মধ্যে দারিদ্র্য-সংগ্রামী মামুনও রয়েছে।
মামুনের স্বপ্ন সফলতায় পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম বললেন, বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। তার স্বপ্নপূরনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগীতা করা হবে। কোথাও ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক কোনো সহযোগীতা লাগলে তাও করা হবে।