মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি, বাকিদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের বড় হার
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সীমানা খুব বড় নয়, উইকেটও ব্যাটিং সহায়ক। ভারতের ব্যাটিং বিস্ময় শচিন টেন্ডুলকারের ঘরের এই মাঠে রান হয় মুড়ি-মুড়কির মতো। যে কারণে এখানকার বিভিন্ন প্যাভিলিয়নের নাম ব্যাটসম্যানদের নামে। আগে ব্যাটিং করা দক্ষিণ আফ্রিকার রান পাহাড় সেটাই প্রমাণ করেছিল।
কিন্তু যে উইকেটে কুইন্টন ডি কক, হেনরিখ ক্লাসেন, ডেভিড মিলাররা খুনে ব্যাটিংয়ে রানের বন্যা বইয়ে দিলেন, সেই উইকেটের চরিত্র হঠাৎ-ই যেন পাল্টে গেল। রান তুলতে সংগ্রাম করতে থাকা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যোগ দিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। পুরো ইনিংসজুড়ে বাজলো ভাঙনের সুর, মেনে নিতে হলো বিশাল এক হার। দুঃস্বপ্নের মাঝে ব্যতিক্রম কেবল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান দেখালেন এই উইকেটে কীভাবে রান করতে হয়।
মঙ্গলবার বিশ্বকাপে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৪৯ রানে হেরে গেছে সাকিব আল হাসানের দল। পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটি জয় পাওয়া বাংলাদেশের এটা টানা চতুর্থ হার। বিশ্বকাপে রানের ব্যবধানে এটা বাংলাদেশের তৃতীয় বড় হার। সবচেয়ে বড় হার ২০৬ রানে, ২০১১ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই। ওয়ানডেতে রানের ব্যবধানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হার ২৩৩ রানে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। টানা চার হারে পয়েন্ট টেবিলে বাংলাদেশ এখন সর্বশেষ দল।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করা দক্ষিণ আফ্রিকা এইডেন মার্করামের হাফ সেঞ্চুরির পর ডি ককের সেঞ্চুরি এবং ক্লাসেন ও মিলারের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ৫ উইকেটে ৩৮২ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে। ২১ ওভারে ১০০, ৩৬ ওভারে ২০০, ৪৪ ওভারে ৩০০; আর শেষের ৬ ওভারে চলে রীতিমতো তাণ্ডব, ৩৬ বলে ৮২ রান তোলে প্রোটিয়ারা। ওয়ানডে ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে এটাই তাদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। এবারের বিশ্বকাপের পাঁচ ম্যাচের মধ্যে চারটিতে আগে ব্যাটিং করে ৩০০'র বেশি রান করলো প্রোটিয়ারা। এর মধ্যে একটি ইনিংস ৪২৮ রানের, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ।
৩৮২ রান পাড়ি দিয়ে জিততে হলে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের রেকর্ড বদলাতে হতো। বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান তাড়া পাকিস্তানের, এবারের আসরেই শ্রীলঙ্কার করা ৩৪৪ রান টপকে জেতে বাবর আজমের দল। ওয়ানডে ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান তাড়া ৩২২ রান। আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে জয় তুলে নেওয়া তো দূরের কথা, এই ম্যাচে সামান্যতম লড়াইও করতে পারলো না বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে চলতে থাকা ব্যাটিং ব্যর্থতা এই ম্যাচেও জারি থাকলো। বরং আগের কয়েক ম্যাচের ব্যর্থতাও ছাড়িয়ে গেল। তবু কিছুটা স্বস্তি যে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরিতে বিশ্বকাপে রানের ব্যবধানে নিজেদের সবচেয়ে বড় হার মেনে নিতে হয়নি। শেষ পর্যন্ত ৪৬.৪ ওভারে ২৩৩ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ।
বড় লক্ষ্য তাড়ায় সাবধানী শুরু করেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম ও লিটন কুমার দাস। ৬ ওভারে ৩০ রানের জুটি গড়েন এ দুজন। কিন্তু সপ্তম ওভারেই দুঃস্বপ্ন হানা দেয় বাংলাদেশের ইনিংসে। এক ওভারেই তামিম ও নাজমুল হোসেন শান্তকে ফিরিয়ে দেন প্রোটিয়া পেসার মার্কো ইয়ানসেন। তামিম ১২ রান করেন, শান্ত রানের খাতাই খুলতে পারেননি। পরের ওভারে আঘান হানেন লিজাড উইলিয়ামস, তার শিকার সাকিব। ২ রানের ব্যবধানে ৩ উইকেট হারিয়ে পথ ভুলে বসে বাংলাদেশ।
এরপর কিছুক্ষণের ব্যবধানে মুশফিকুর রহিম ও লিটন ফিরে গেলে দিশা হারিয়ে বসে তারা। মুশফিক ৮ ও লিটন ২২ রান করেন। ইনিংস সেরা রান করা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই করার চেষ্টা করেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি, স্লগ সুইপ করতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন ১১ রান করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। এরপর বাকিদের নিয়ে অনেকটা পথ লড়ে যান মাহমুদউল্লাহ।
সপ্তম উইকেটে নাসুম আহমেদের সঙ্গে ৪১ রানের জুটি গড়েন অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান, যা বাংলাদেশের ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নাসুম ২২ রান করে থামলে হাসান মাহমুদকে নিয়ে এগোতে থাকেন মাহমুদউল্লাহ, এই জুটি থেকে আসে ৩৭ রান। ১৫ রান করে আউট হন হাসান। এরপরও খেই হারাননি মাহমুদউল্লাহ, এবার লড়াই শুরু করেন মুস্তাফিজুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে। বাঁহাতি পেসারের সঙ্গে ইনিংস সেরা ৬৮ রানের জুটি গড়ার পথে পূর্ণ করেন বিশ্বকাপের তৃতীয় সেঞ্চুরি। দুই সেঞ্চুরির মালিক সাকিবকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপে এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক তিনি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ছয় সেঞ্চুরির তিনটিই এখন তার।
৮১ রানে ৬ উইকেট হারানো দলকে ২২৭ রান পর্যন্ত নিয়ে যান ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া মাহমুদউল্লাহ। ৪৬তম ওভারে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হন তিনি। দলের চরম দুঃসময়ে দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ১১১ বলে ১১টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১১ রানের দারুণ ইনিংস খেলেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া অতিরিক্ত ১৭ রান বাদ দিলে দলের বাকি ১০ ব্যাটসম্যানের চেয়ে একাই বেশি রান করেছেন মাহমুদউল্লাহ।
তার ইনিংসটি কেবল এই ম্যাচেরই নয়, চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ। ৫ ম্যাচে তার রান ১৯৮, এটাও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ। দক্ষিণ আফ্রিকার জেরাল্ড কোয়েটজে ৩টি উইকেট নেন। ২টি করে উইকেট পান ইয়ানসেন, উইলিয়ামস ও রাবাদা। একটি উইকেট নেন কেশব মহারাজ।
এর আগে ব্যাটিং করে রান পাহাড় গড়লেও দক্ষিণ আফ্রিকার শুরুটা বলার মতো ছিল না। দলীয় ৩৪ রানের মধ্যেই রিজা হেনড্রিকস ও রাসি ভ্যান ডার ডুসেনকে ফিরিয়ে দেন শরিফুল ইসলাম ও মেহেী হাসান মিরাজ। কিন্তু এই চাপ দলকে বুঝতেই দেননি ডি কক ও মার্করাম। তৃতীয় উইকেটে ১৩১ রানের জুটি গড়ে তোলেন এ দুজন। ৬৯ বলে ৭টি চারে ৬০ রান করা মার্করামকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন সাকিব আল হাসান।
এতেও দক্ষিণ আফ্রিকার রান তোলার গতিতে ভাটা পড়েনি, বরং গতি আরও বেড়ে যায়। বাংলাদেশের বোলারদের ওপর দিয়ে তাণ্ডব চালান ডি কক ও ক্লাসেন। এই জুটি ৮৭ বলে ১৪২ রান যোগ করে। সেঞ্চুরি পেরিয়ে ডাবল সেঞ্চুরির পথে ছিলেন ডি কক। কিন্তু হাসান মাহমুদের ফুল টসে ছক্কা মারতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন বাঁহাতি এই ওপেনার। ফেরার আগে ১৪০ বলে ১৫টি চার ও ৭টি ছক্কায় ১৭৪ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেন তিনি।
বিশ্বকাপে এটাই তার সেরা ইনিংস এবং ওয়ানডের দ্বিতীয় সেরা। ওয়ানডেতে এটা ডি ককের ২০তম সেঞ্চুরি। ডি ককের বিদায়ের পর ক্লাসেন ও মিলার বাংলাদেশের বোলারদের পথ ভুলিয়ে দেন, চলতে থাকে চার-ছক্কার শো। এই জুটি মাত্র ২৫ বলে ৬৫ রান যোগ করে। ৪৯ বলে ২টি চার ও ৮টি ছক্কায় ৯০ রানের দানবীয় ইনিংস খেলেন ক্লাসেন।
মিলার ১৫ বলে একটি চার ও ৪টি ছক্কায় ৩৫ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন। সুবিধা করতে পারেননি বাংলাদেশের কোনো বোলারই। সবচেয়ে বেশি ১১.১৬ ইকোনমিতে ৬ ওভারে ৬৭ রান দেওয়া বাংলাদেশের পেসার হাসান মাহমুদ ২টি উইকেট নেন। সবচেয়ে কম ইকোনমিতে ৪৪ রান খরচায় একটি উইকেট নেন মিরাজ। শরিফুল ও সাকিবও একটি করে উইকেট পান। দুজনই ওভার প্রতি ৭ রানের বেশি করে খরচা করেন।