গরুর শরীর থেকে তৈরি হবে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জরুরি অ্যান্টিবডি পাওয়া যাবে গরুর শরীর থেকে। বিজ্ঞানীদের নতুন এই আবিষ্কারে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন হয়তো ভারতের বাবা রামদেব। এখন আর তাকে গরুর মূত্র খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা অঞ্চলের একটি বায়োটেক প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা এমনই একধরণের গরুর জেনেটিক নকশা করছেন। আগামী গ্রীষ্মেই এই ওষুধের ট্রায়াল শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী 'সায়েন্স' ম্যাগাজিনের এক প্রবন্ধে এমন তথ্যই জানা গেল।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির সংক্রামক রোগের চিকিৎসক আমেশ আদালজা বলেন, 'এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফল। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে যত বেশি ব্যবস্থা উদ্ভাবন হয় তত ভালো।'
বিভিন্ন রোগের অ্যান্টিবডি পেতে এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জিনগতভাবে নকশা করা কোষ বা তামাক পাতা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ২০ বছর আগেই দুধ উৎপন্নকারী প্রাণীর শরীর থেকে অ্যান্টিবডি তৈরির পরীক্ষা শুরু করে সাউথ ডাকোটার এসএবি বায়োথেরাপিউটিকস। এজন্য তারা জিনগতভাবে নকশা করা এ সব গাভীর শরীরে ভাইরাসটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করায়। এই গাভীগুলোর কোষে এমন ডিএনএ থাকে যা ভাইরাসগুলোর সংস্পর্শে এসে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। পরে এই অ্যান্টিবডি মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, গরু কেন? অন্য কোন প্রাণী নয় কেন?
ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গের ভাইরাল ইমিউনোলজিস্ট উইলিয়াম ক্লিমস্ট্রা বলেন, 'এই গরুগুলো বিশাল আকারের বায়োরিঅ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।'
সাধারণত অন্যকোন প্রাণীর চাইতে আকারে বড় হওয়ার কারণে গরুর শরীরে প্রচুর রক্ত উৎপন্ন হয়। জিনপ্রকৌশলের মাধ্যমে উৎপাদিত এইসমস্ত গরুর রক্ত মানুষের শরীরের অনুরূপ প্রোটিন সমন্বয় করতে পারে অনেক দ্রুত। আর শুধু তাই নয়, এই গরুর রক্তে প্রতি মিলিলিটারে মানুষের রক্তের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এমনটাই জানান এসএবি বায়োথেরাপিউটিকসের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এডি সুলিভান।
গরুর রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি তৈরির আরেকটি সুবিধা রয়েছে, পৃথিবী জুড়ে অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিবডি তৈরি করছে তাদের মূল পরিকল্পনা হলো একই ধরণের বা মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন করা। এই অ্যান্টিবডিগুলো মূলত ভাইরাসের যেকোন একটি অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন, কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে শুধু ভাইরাসের উপরিতলের স্পাইকগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে এই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি।
কিন্তু জিনপ্রকৌশলের মাধ্যমে উৎপাদিত এসব গরুর রক্ত থেকে একাধিক প্রকৃতির অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অর্থাৎ পলিক্লোনাল অ্যান্টিবডি, যা ভাইরাসের একাধিক অংশকে চিহ্নিত করতে পারে। এবং মানুষও এভাবেই বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বলে জানান সুলিভান।
আর তাই গরুর রক্তের প্রোটিন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আর এক্ষেত্রে ভাইরাসটি যদি জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে নিজের আকার বা প্রকৃতি পালটে ফেলে তাহলেও পলিক্লোনাল অ্যান্টিবডি ঠিকই এর কোন না কোন অংশকে চিহ্নিত করে ফেলবে এবং অ্যান্টিবডি তৈরি করে যাবে তখনো।
আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এসএবি বায়োথেরাপিউটিকস এই অ্যান্টিবডির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে পারবে বলে জানালেন সুলিভান।
তবে সবাই যে এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন অ্যান্টিবডির ব্যাপারে আশাবাদী তা নয়। বোস্টন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ মনিশ সাগর জানান, 'গরুর রক্ত থেকে তৈরি এই অ্যান্টিবডি যে অন্য পদ্ধতিগুলোর চেয়ে বেশি কার্যকর এবং সাশ্রয়ী, এব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।'
যদিও এই অ্যান্টিবডিকেই সবচাইতে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন অনেক বিজ্ঞানী ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ। ওয়াশিংটন স্কুল অফ মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জেফ্রি হেন্ডারসন জানান, 'অ্যান্টিবডি উৎপাদনের এই প্রক্রিয়া নিখুঁত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই হচ্ছে। আর এই প্রক্রিয়া আজকের নতুন নয়, একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসরণ করেছেন আমাদের পূর্বসূরীরা।'