হাইকোর্টের ঘোষণা: বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার
হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করেছেন।
আদালত বলেছেন, 'বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। প্রত্যেক নাগরিককে তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রদানের নিমিত্তে আমরা ঘোষণা করছি যে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। তেমনি বিনামূল্যে ভেজালমুক্ত তথা নির্ভেজাল ওষুধ পাওয়াও প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।'
ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনে ১০৪ শিশুর মৃত্যুর দুটি ঘটনায় তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ ঘোষণা দেন। ৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় বুধবার প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেক পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা দেয় হয়েছে রায়ে। এ ছাড়াও একটি স্বাধীন জাতীয় ভেজাল ঔষধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন আদালত।
রায়ে আদালত বলেন, 'এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও অবকাঠামো প্রশংসনীয় স্তরে উন্নীত হয়েছে। আমাদের ওষুধ শিল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নিয়মিত আমদানি করছে। অনেক প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়ালেখা করতে আসছে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তব অবস্থা এমন যে, উন্নত ও সু-চিকিৎসা কেবলমাত্র ধনী এবং উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমিত। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তসহ দেশের আপামর সাধারণ জনগণ বলতে গেলে উন্নত চিকিৎসা ও সুচিকিৎসা হতে বঞ্চিত। তারা কেবল নামেমাত্র সামান্য চিকিৎসা পায়।'
হাইকোর্ট বলেন, দেশের আপামর জনসাধারণের করের টাকায় সাংবিধানিক পদাধিকারী ব্যক্তিসহ সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিদেশে হরহামেশা উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। এমনকি বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের নেতা ও নেত্রীদেরও আমরা দেখি প্রায়ই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে। কিন্তু, সাধারণ জনগণের তার ন্যূনতম সুযোগ নেই। অর্থাৎ, যে জনগণের টাকায় এসব ব্যক্তিরা বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান, সেই জনগণের কিন্তু বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, যারা সংবিধান মোতাবেক এ দেশটির মালিক, তারা কিন্তু বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যেতে চান না। তারা চান দেশে বিদেশের মতো উন্নত চিকিৎসা সুবিধা থাকুক সকলের জন্য।
সংবিধানের রেফারেন্স দিয়ে হাইকোর্ট রায়ে বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) অনুযায়ী নাগরিকদের জীবন ধারণের অন্যতম মৌলিক উপকরণ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।
অনুচ্ছেদ ১৫(ঘ) অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিককে তার অন্যতম সামাজিক অধিকার- ব্যাধি তথা রোগ থেকে আরোগ্য লাভের নিমিত্তে সকল প্রকার সরকারি সাহায্য প্রদান নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ মোতাবেক রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হলো "জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন" এবং রাষ্ট্র এটিকে অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে।
১৯৯১ সালে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডফ্লেম ফার্মাসিউটিক্যালসের ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবন করে ৭৬ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০০৯ সালে রীড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে আরও ২৮ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগে মামলা হয় ।
এ দুই ঘটনা নিয়ে ওই সময় প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন যুক্ত করে ঘটনার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি এবং যথাযথ নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাই কোর্টে জনস্বার্থে রিট আবেদন করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।
সেই রিট আবেদনের বিষয়ে তখন শুনানি শেষে রুল জারি করে সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা নেয় আদালত। পরে ২০২২ সালে রুল নিষ্পত্তি করে আদালত ক্ষতিপূরণের রায় দেয়। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রত্যেক ব্যক্তির বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া মৌলিক অধিকার ঘোষণা ছাড়াও হাইকোর্ট ওষুধে ভেজাল মিশ্রণ বন্ধে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(সি) মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রতিপক্ষদের নির্দেশ; ১৯৯১ সালে ৭৬ জন এবং ২০০৯ সালে ২৮ জন শিশুর মৃত্যু ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কঠিন দাযয়ে দায়ী ঘোষণা এবং একটি স্বাধীন জাতীয় ভেজাল ঔষধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রদান করে রয়ে। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের আদলে আমাদের দেশের জনগণের চিকিৎসা সেবা অবকাঠামো তৈরি করার পরামর্শ প্রদান করেন আদালত।