দক্ষিণ আফ্রিকাকে কাঁদিয়ে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া
বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল মানেই দক্ষিণ আফ্রিকার দুঃখগাথা। বিশ্বকাপ আসে, বিশ্বকাপ যায়; সেমি-ফাইনালই হয়ে থাকে প্রোটিয়াদের শেষ সীমানা। এবারও সেটার ব্যতিক্রম হলো না, আবারও ফিরে এলো তাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগে থাকা 'চোকার' শব্দটি। সেই শেষ চারের লড়াইয়ে ফের খেই হারালো দক্ষিণ আফ্রিকা, রোমাঞ্চকর জয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া।
বৃহস্পতিবার কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে লো স্কোরিং দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে চরম উত্তেজনা শেষে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩ উইকেটে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। এবার নিয়ে রেকর্ড অষ্টমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলো অজিরা। আগের সাত ফাইনালের মধ্যে পাঁচটিই জেতে তারা। পাঁচবার সেমি-ফাইনাল খেলেও বিশ্বকাপ ফাইনাল স্বপ্নই থেকে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার। এ নিয়ে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনটি সেমি-ফাইনালে হারলো তারা।
টস জিতে ব্যাটিং করা দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৯.৪ ওভারে ২১২ রানে অলআউট হয়ে যায়। ছয়ে নেমে ১২ থেকে ৪৮ ওভার পর্যন্ত ব্যাটিং করেন সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া ডেভিড মিলার, তার ব্যাটেই মূলত ২০০ পেরোয় প্রোটিয়ারা। এ ছাড়া হেনরিখ ক্লাসেন ৪০ ছাড়ানো ইনিংস খেলেন। বাকিদের কেউ-ই ২০ রানের গন্ডি পেরোতে পারেননি।
জবাবে এই রান তুলতেই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয় অস্ট্রেলিয়াকে। সামান্য পুঁজি নিয়ে দারুণ লড়ে প্রোটিয়ারা, জাগায় জয়ের সম্ভাবনাও। কিন্তু ম্যাচসেরা ট্রাভিস হেড, স্টিভ স্মিথ, মার্নাস লাবুশেন, জশ ইংলিস, মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্সদের ব্যাটে সব রোমাঞ্চের পথ পেরিয়ে ৪৭.২ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে জয় নিশ্চিত করে বিশ্বকাপের সফলতম দলটি। আগামী ১৯ নভেম্বর আহমেদাবাদে ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হবে অস্ট্রেলিয়া।
যদিও ছোট লক্ষ্য তাড়ায় দাপুটে শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার ওয়ার্নার ও হেড। যে উইকেটে রান তুলতে দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানদের নাভিঃশ্বাস অবস্থা হয়ে গিয়েছিল, সেই উইকেটেই দাপুটে ব্যাটিং করতে থাকেন তারা। ৬ ওভারেই স্কোরেকার্ডে ৬০ রান যোগ করে ফেলেন ওয়ার্নার ও হেড। নিজেদের প্রথম তিন ওভারে মার্কো ইয়ানসেন ৯ ও কাগিসো রাবাদা ১০.৬৬ ইকোনমিতে রান খরচা করেন।
এমন শুরুর পরও হঠাৎ-ই অস্ট্রেলিয়াকে পেসে বসে প্রোটিয়ারা। সপ্তম ওভারে ওয়ার্নারের স্টাম্প উপড়ে নেন এইডেন মার্করাম। ১৮ বলে একটি চার ও ৪টি ছক্কায় ২৯ রান করে আউট হন অজি ওপেনার। এক রান পরই মিচেল মার্শকে ফিরিয়ে দেন রাবাদা। ৬ ওভারে বিনা উইকেটে ৬০ রান থেকে ৬১ রানে ২ উইকেট। এরপরও অবশ্য দলকে চাপ বুঝতে দেননি হেড। এই অবস্থায়ও স্মিথকে এক পাশে রেখে মারকুটে ব্যাটিং করতে থাকেন তিনি।
তৃতীয় উইকেটে ৩৯ বলে ৪৫ রানের জুটি গড়েন হেড-স্মিথ। এর মধ্যে ৩৬ রানই করেন ম্যাচসেরা হেড। দলীয় সংগ্রহ ১০০ পেরিয়ে থামেন বাঁহাতি এই ওপেনার। এর আগে খেলেন ৪৮ বলে ৯টি চার ও ২টি ছক্কায় ৬২ রানের দারুণ এক ইনিংস ইনিংস। যদিও আরও আগেই ফিরে যেতে পারতেন তিনি। ব্যক্তিগত ৪০ রানে একবার জীবন পান হেড, তার তোলা ক্যাচ ফেলেন দেন হেনড্রিকস। ১৪তম ওভারে ৫৭ রানে স্লিপে তার ক্যাচ ছাড়েন হেনরিখ ক্লাসেন।
অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে দলীয় ১৩৩ রানে লাবুশেনকে হারিয়ে। ১৮ রান করে লানুশেন আউট হওয়ার ৪ রান পর তাবরাইজ শামসির শিকারে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। স্মিথ ও ইংলিসের ব্যাটে আবারও স্বস্তি ফেরে অজি শিবিরে। প্রচন্ড চাপের মাঝে ৫৯ বলে ৩৭ রানের জুটি গড়েন তারা। ৬২ বলে ২টি চারে ৩০ রান করা স্মিথকে আউট করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবারও খেলায় ফেরান জেরাল্ড কোয়েটজা।
স্টার্ককে সঙ্গে নিয়ে এগোতে থাকেন ইংলিস। কিন্তু এই জুটি দীর্ঘ হতে দেননি কোয়েটা। ৪৯ বলে ৩টি চারে ২৮ রান করা ইংলিশকে ফিরিয়ে ১৯ রানের জুটি ভাঙেন তিনি। জয় থেকে তখন তিন উইকেট দূরে দক্ষিণ আফ্রিকা, উইকেটে থাকা স্টার্ক ও কামিন্স তখন মহাচাপে। কিন্তু এ দুজন খেই হারাননি। সুযোগ বুঝে বুঝে টেস্টের মতো কয়েক বল পরপর রান নিয়ে এগিয়েছেন তারা। শেষ পর্যন্ত ৪৬ বলে তাদের করা ২২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতেই জয় মেলে অস্ট্রেলিয়ার। স্টার্ক ৩৮ বলে ১৬ ও কামিন্স ২৯ বলে ১৪ রানে অপরাজিত থাকেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়েটজা ও শামসি ২টি করে উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান রাবাদা, মার্করাম ও মহারাজ।
এর আগে ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম ওভারেই উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। স্টার্কের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে থামেন দলটির অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। শুরুতেই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া দক্ষিণ আফ্রিকা ধুঁকতে শুরু করে, স্টার্ক-হ্যাজেলউডদের সামনে রান তুলতে সংগ্রাম করতে থাকেন কুইন্টন ডি কক, রাসি ভ্যান ডার ডুসেনরা। ৫ ওভারে মাত্র ৮ রান জমা হয় প্রোটিয়াদের স্কোরকার্ডে।
ষষ্ঠ ওভারে গিয়ে আউট হন বিশ্বকাপে দারুণ ছন্দে থাকা ডি কক। হ্যাজেলউডের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের হাতে ধরা পড়েন এবারের বিশ্বকাপে চারটি সেঞ্চুরি করা বাঁহাতি এই প্রোটিয়া ওপেনার। কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটি রানই তুলতে পারছিল না। ১০ ওভারে মাত্র ১৮ রান তোলে তারা। এর মধ্যে ১১তম ওভারে সাজঘরে ফিরতে হয় এইডেন মার্করামকে।
২২ রানে ৩ উইকোট হারানো দলটি গুছিয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি, ১১তম ওভারে রাসি ভ্যান ডার ডুসেনকে ফিরিয়ে দেন হ্যাজেলউড। ২৪ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তখন মাঝ দরিয়ায়। এখান থেকে দিকহারা দলের হাল ধরেন মিলার ও ক্লাসেন। বিপর্যয় কাটিয়ে জুটি গড়ে তোলা এই দুই ব্যাটসম্যান পঞ্চম উইকেটে ৯৫ রান যোগ করেন, তাদের ইনিংসে এটাই সবচেয়ে বড় জুটি।
ক্লাসেন ৪৮ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় ৪৭ রান করে বিদায় নেওয়ার পর মিলার একাই প্রায় শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যান। সপ্তম উইকেটে জেরাল্ড কোয়েটজার সঙ্গে ৫৩ রানের জুটি গড়েন ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি পূর্ণ করা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৪৮তম ওভারে আউট হওয়ার আগে ১১৬ বলে ৮টি চার ও ৫টি ছক্কায় ১০১ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন মিলার। এটা বিশ্বকাপে তার দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, ওয়ানডের ষষ্ঠ।
মিলারকে অনেকটা সময় সঙ্গ দেওয়া কোয়েটজা ১৯ রান করেন। এ ছাড়া মার্করাম ১০ ও কাগিসো রাবাদা ১০ রান করেন। দলটির ছয়জন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের রান করতে ব্যর্থ হন। স্টার্ক ও কামিন্স ৩টি করে উইকেট নেন। ২টি করে উইকেট পান হ্যাজেলউড ও ট্রাভিস হেড। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী স্টার্ক এই ম্যাচ দিয়ে নিজেকে আরেকটু এগিয়ে নিয়েছেন। ২৭ ম্যাচে তার উইকেট ৬২টি, যা বিশ্বকাপের তৃতীয় সর্বোচ্চ।