এআইআইবির অর্থায়নের প্রকল্পে ধীরগতির কারণে অর্থছাড়েও বিলম্ব হচ্ছে
দুই লেনের সিলেট সিলেট-তামাবিল মহাসড়ককে ৪ লেনে সম্প্রসারণ করতে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র সাথে ২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর ৪০৪ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে সরকার। ২০২৫ সালের জুনে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
কিন্তু, ঋণ চুক্তির তিন বছর পরেও এখনও দুই লেনেরই রয়ে গেছে এই মহাসড়ক। প্রকল্পের ভৌত বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় চীনের নেতৃত্বাধীন এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানও কোনো অর্থছাড় করেনি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংস্থাটি অর্থায়নের বাস্তবায়নাধীন ১৩ প্রকল্পেরও একই পরিস্থিতি।
'এআইআইবির সঙ্গে ডকুমেন্ট আদান-প্রদান দ্রুত করতে অনলাইনে যোগাযোগ পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।'
বাস্তবায়ন এবং বৈদেশিক অর্থ ছাড়, ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তর, প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি)-র ঘন ঘন পরিবর্তন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্ব এবং প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনের চিরচেনা সমস্যাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে ইআরডির প্রতিবেদনে। এ ছাড়া, এআইআইবির কোন আঞ্চলিক অফিস না থাকায় প্রকল্পের তহবিল ছাড়েও বেশি সময় লাগে বলে এতে বলা হয়েছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এসব প্রকল্পে ২.০৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে এআইআইবি। এরমধ্যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ বা ৪৫৮.৪৫ মিলিয়ন ডলার।
যদিও এসব প্রকল্পের বেশিরভাগের অনুমোদিত বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বাকিগুলোও শেষ পর্যায়ে। অনেক ঋণের ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আটকে আছে অর্থছাড়। অন্যদিকে, অব্যবহৃত ঋণের ওপর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিটমেন্ট ফি দিতে হচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ঠিকাদারের বিল পরিশোধ বিলম্ব হওয়ার কারণে– ঠিকাদারও কাজে উৎসাহ হারাচ্ছে এবং বাস্তবায়ন কাজও করছে ধীরগতিতে। শুধুমাত্র বিল সংক্রান্ত এবং অন্যান্য দলিলের হার্ড কপি এআইআইবির অফিসে পাঠাতে দেড় মাস সময় লাগে। এই সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি বিলের ক্ষেত্রে।
এসব সমস্যা সমাধানে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে সভা করেছে ইআরডি। বৈঠকে এআইআইবির কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
ইআরডির যুগ্ম সচিব মিরানা মাহরুখ বলেন, 'এআইআইবির সঙ্গে ডকুমেন্ট আদান-প্রদান দ্রুত করতে অনলাইনে যোগাযোগ পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, খরচ কমাতে দেশ-ভিত্তিক অফিস চালুর পরিকল্পনা করছে না এআইআইবি।তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এআইআইবির একটি অঞ্চলিক অফিস স্থাপন করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আরেকটি অফিস চালুর প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এটা ঢাকায় করা যায় কিনা, সে বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত চীনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এ উন্নয়ন সহায়তা ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ এপর্যন্ত ১৭ প্রকল্পে ৩.৩৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বা ঋণ চুক্তি সই করেছে। এই সংস্থা থেকে নেওয়া মোট ঋণের স্থিতি ১.৫০ বিলিয়ন ডলার, যার অর্ধেকের বেশি এসেছে বাজট সহায়তা ঋণ হিসেবে। বাজেট সহায়তার ঋণ চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাড় হয়ে যায়। কিন্তু, প্রকল্প ঋণ ছাড় হয় বাস্তবায়ন কাজে অগ্রগতির ভিত্তিতে।
শুরুতেই বিলম্ব
ময়মনসিংহ শহরের ব্যস্ততম কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে ট্রাফিক সরিয়ে যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এআইআইবি। পুরাতন ব্রহ্মপূত্র নদের উপর ওভারপাস ও এপ্রোচ সড়কসহ সেতুটি নির্মিত হবে।
২০২১ সালের নভেম্বরে এই প্রকল্পে জন্য ২৬০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি হয় এআইআইবির সঙ্গে। কিন্তু, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পে অর্থছাড় মাত্র ২.০৭ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পে এখনো কোনো ভৌত অগ্রগতি হয়নি।
ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তর সংক্রান্ত জটিলতায় প্রকল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। ভূমি অধিগ্রহণের মেয়াদ বাড়াতে হতে পারে এবং ইতোমধ্যেই অতিরিক্ত বরাদ্দের আগাম অনুমোদনও নেওয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক নূর -ই- আলম বলেন, এই প্রকল্পের পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ হয়ে গেছে। অবশ্য ভূমি অধিগ্রহণে কিছু সমস্যা রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের কাজটি করেন ডেপুটি কমিশনার। তারা এই বিষয়ে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, 'গত সপ্তাহে এই প্রকল্পের একটি কিস্তি ছাড় করেছে এআইআইবি। ফলে এই প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণে অর্থছাড় বেড়ে হয়েছে ১০.৫ মিলিয়ন ডলার।
ভূমি অধিগ্রহণ
বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন প্রকল্পেও একই ধরনের জটিলতায় অর্থছাড় আটকে রয়েছে। এ ধরনের একটি প্রকল্প হলো– পাওয়ার সিস্টেম আপগ্রেড অ্যান্ড এক্সপানশন (চট্টগ্রাম অঞ্চল) প্রকল্প। এই প্রকল্পে এআইআইবি ঋণ দেবে ১২০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু, চার বছরে অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ১৩.৯৮ মিলিয়ন ডলার।
প্রকল্প সংশ্লিস্ট পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-র কর্মকর্তারা জানান, 'রাইট অব ইস্যুর' সমস্যা রয়েছে এই প্রকল্পে, যেকারণে জনগণ বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপনে বাধা দেয়, এতে বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত হয়।
যতটুকু জায়গায় খুঁটি স্থাপন করা হবে শুধুমাত্র সে জায়গাটুকুর জন্য জমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার একটি আইন করা হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু, বাস্তবে যে জমিতে খুঁটি স্থাপন করা হয়, সেই জায়গায় জমির মালিক কোনো অবকাঠামো স্থাপন করতে পারে না, বা জমিতে চাষ করতেও সমস্যায় পড়েন। এসব জটিলতায় খুঁটি স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণে বাধা দিয়ে আসছেন তাঁরা। আর এতে প্রকল্পের বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, অবকাঠামো প্রকল্পে সাধারণত প্রথম দুই বছর কোনো খুব বেশি বৈদেশিক তহবিলের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, এআইআইবির অব্যহৃত ঋণের জন্য কমিটমেন্ট ফি নিচ্ছে, যা এই প্রকল্পকেও বহন করতে হচ্ছে।
এআইআইবির স্থানীয় অফিস না থাকার সমস্যা
এআইআইবির স্থানীয় অফিস না থাকা এবং বিল পরিশোধের বিলম্বের কারণে পিজিসিবির আরেকটি সঞ্চালন লাইনের প্রকল্পেও বাস্তবায়ন কাজ চলছে ধীর গতিতে।
প্রকল্পটি হলো 'ঢাকা ওয়েস্টার্ন জোন ট্রান্সমিশন প্রজেক্ট গ্রিড এক্সপানশন'। ২০১৯ সালের জুন মাসে এই প্রকল্পের জন্য এআইআইবির সঙ্গে ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়। অর্থছাড়ের সমস্যায় পড়েছে এ প্রকল্পও।
একইভাবে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা ওয়াসার 'ঢাকা স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্প' এর জন্য ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ১৭০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। কিন্তু, মোট ঋণের মধ্যে ছাড় হয়েছে মাত্র ৮.৬ মিলিয়ন ডলার।
ইআরডির প্রতিবেদনে, উভয় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার কারণ হিসেবে দরপত্র প্রক্রিয়া ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিলম্বের জন্য ত্রুটিপূর্ণ ব্যয় প্রাক্কলনের কথা উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া, 'রোড কাটিং' এর জন্য সম্মতি আদায়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত হচ্ছে বলেও ইআরডির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রকল্পটি আগামী বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও– ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৭.১৩ শতাংশ।
এ ধরনের আরেকটি প্রকল্প হলো– 'কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রজেক্ট।' এ প্রকল্পে অর্থায়নকারী হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি। এরমধ্যে এআইআইবির সঙ্গে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা এ প্রকল্পের অর্থছাড় করেছে মাত্র ১৫.৩১ মিলিয়ন ডলার। পরে ৩২.৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিল করা হয়েছে।
এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে, যার ওপর ভিত্তি করে ভৌত কাজে ৭৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান।